মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশগুলো মিলে এক ধরনের মোর্চা গড়ে তুললেও যুদ্ধ-বিরোধী মনোভাব নিয়ে সারা বিশ্বই যে সেই মোর্চায় যুক্ত হয়ে পড়েছে- বাস্তবে সেটি ঘটেনি৷
আবার রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রগুলো প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে পশ্চিমাবিরোধী আরেকটি জোটও গড়ে তোলেনি৷ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো আর রাশিয়ার মুখোমুখি অবস্থানের অনেক দেশই নিজেদের মতো করে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে৷
ভিন্ন অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অবস্থান অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কারো কারো সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মাখামাখি, কারো কারো সাথে সীমাহীন বৈরীতা- বিশ্বব্যাপী নতুন একটি অস্থির পরিস্থিতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলে সেদিকে সবারই কৌতূহলী দৃষ্টি ছিল৷ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘শাস্তিমূলক পদক্ষেপ’ আর বিরোধিতায় নাস্তানাবুদ হওয়া ইরান কী ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তা নিয়েও কৌতূহলের কমতি ছিল না৷ বাস্তবতা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, বিশেষ করে প্রভাবশালী দেশগুলো এক ধরনের ভারসাম্যমূলক অবস্থানে নিজেদের সীমিত রেখেছে৷
পর্যবেক্ষকদের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে৷ সিরিয়া বরাবরের মতোই রাশিয়াপন্থি হিসেবে অবস্থান নিয়েছে৷ সিরিয়ার বর্তমান শাসককে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাশিয়ার সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে, কিংবা রাশিয়া বরাবরই বর্তমান সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে পাশে থেকেছে৷ সিরিয়া রাশিয়ার পক্ষেই প্রকাশ্যে অবস্থান নেবে - এটাই স্বাভাবিক৷ রাশিয়ার হয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে শামিল হতে সিরিয়া প্রস্তুত- এমন একটি বার্তা তারা আগেভাগেই দিয়ে রেখেছিল৷
লেবানন এবং কুয়েত- দুটি দেশই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দখলের শিকার হয়েছে এবং তাদের অবস্থান প্রতিবেশী দেশকর্তৃক অন্য দেশ দখল চেষ্টার বিপক্ষে৷ আরব দেশগুলোর মধ্যে লেবাননই সম্ভবত একমাত্র দেশ, যারা সরাসরি বিবৃতি দিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের সমালোচনা করেছে৷ এর প্রতিক্রিয়ায় বৈরুতে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘‘দুঃসময়ে কারা আমাদের পক্ষে থাকে, কারা বিরোধিতা করে সেটা আমরা সবসময় মনে রাখি৷’’ আর কুয়েত জাতিসংঘের অধিবেশনে দেয়া বক্তৃতায় সরাসরি রাশিয়াকে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তৃতা করেছে৷
তবে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দেশগুলোর প্রায় সবার অবস্থানই অনেকটা ‘ফেন্স সিটারের’ ভুমিকায়, অনেকটা বেড়ায় বসে বসে পরিস্থিতি অবলোকন করার মতো৷ তারা সরাসরি রাশিয়ার বিরোধিতায় নামছে না, আবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও সোচ্চার হয়ে উঠছে না৷ বরং অ্যামেরিকাকে কিছু বার্তা দিয়ে তারা অনেকটা ভারসাম্যমূলক একটা অবস্থানে থাকার চেষ্টা করছেন৷ এদের মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), সৌদি আরব এবং মিশর৷ এই তিনটি দেশেরই যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরনের টানাপড়েন আছে৷ আবার মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সরকার প্রধানের সাথেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিদ্যমান৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিদ্যমান এই বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন৷
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলা শুরুর পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং কর্মতৎপরতা পর্যালোচনা করেই তারা এই ধরনের একটা উপসংহার টানার চেষ্টা করছেন৷ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর ২৮ ফেব্রুয়ারি আরব লীগ যে বিবৃতি দেয় তাতে রাশিয়া যে আগ্রাসন চালিয়েছে’- তার উল্লেখ ছিল না৷ পরিস্থিতিকে একটি সংকট হিসেবে উল্লেখ করে কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানানো হয়েছিল৷ এখন পর্যন্ত তারা এই অবস্থান থেকে তেমন একটা সরে যায়নি৷ ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন কার্যক্রমেও তাদের এই অবস্থানই ছিল৷ এমনকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে এবং ইউক্রেনে সামরিক অভিযান বন্ধে জাতিসংঘের দুটি অধিবেশনে ভোটাভুটিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত অনুপস্থিত থেকেছে৷ অথচ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য একমাত্র আরব দেশ এই সংযুক্ত আরব আমিরাত৷ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এই সভায় ইউক্রেন নিয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাবে ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৪১টি দেশ পক্ষে এবং ৫টি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছে৷ ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে৷ পক্ষে ভোট দেয়া ৫টি দেশের একটি দেশ হচ্ছে সিরিয়া৷ ভোটদানে বিরত থাকা দেশগুলোর মধ্যে ইরান, ইরাকসহ বেশ কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ রয়েছে৷
এর বাইরে ইরানের অবস্থানটা অবশ্যই আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা অর্থনৈতিক অবরোধের ধাক্কায় ঠোকর খেতে খেতে এগিয়ে চলা ইরানের অবস্থান এবং ভূমিকার দিকে সঙ্গত কারনেই সবার কৌতূহলী দৃষ্টি৷ ইরান সরকার নিজেদের ‘ভারসাম্যমূলক’ অবস্থানে থাকার দাবি করলেও দেশটির উদারপন্থি বুদ্ধিজীবী এবং জনসাধারণের কাছে কাছে সেটি ভিন্ন রকম৷
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউক্রেনে হামলার পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে বক্তব্য দেন৷ তিনি ‘ন্যাটোর উসকানিমূলক অবস্থান’ এই পরিস্থিতি সৃস্টি করেছে বলে উল্লেখ করেন৷ সারা বিশ্ব যখন ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের সমালোচনায় মুখর, তখন ইরানের এই অবস্থান পর্যবেক্ষকদের মনোযোগ কাড়ে৷ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরান রাশিয়ার সামরিক হামলার সমালোচনা পর্যন্ত করেনি৷ তবে রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের দুদিনের মধ্যেই ইরানে রাশিয়াবিরোধী, যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ হয়েছে৷ সংখ্যায় স্বল্প সংখ্যক লোকের উপস্থিতিতে সেই প্রতিবাদ হলেও সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন ইরানের উদারপন্থিরা৷ সেই সমাবেশে রাশিয়ার আগ্রাসনের পাশাপাশি ইরান সরকারের ভূমিকারও সমালোচনা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়৷ তবে ইরানের ক্ষমতা বলয়ের অবস্থানটা অবশ্যই অন্যরকম৷
ইরানের ক্ষমতাসীনরা স্পষ্টতই পশ্চিমবিরোধী, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী৷ ইউক্রেন পরিস্থিতিতে সঙ্গত কারণেই সরকারিভাবে ইরানের অবস্থান পশ্চিমে যে জোট গড়ে উঠেছে, তার বিপরীতমুখী৷ পশ্চিমের বিরোধিতা এবং অ্যামেরিকার শাস্তিমূলক অবরোধে থাকা ইরান নিজেদের অস্তিত্বের কারণে পূবমূখী নীতিমালা নিয়ে টিকে থাকার লড়াই করেছে৷ রাশিয়ার সহযোগিতা সে পেয়েছে, চীনের সঙ্গেও তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে৷ ইরান তার নিজের অস্তিত্বের জন্যই ‘মস্কো- বেইজিং’ বেড়াজাল গড়ে তুলেছে৷ সেই বেড়াজালের বেষ্টনিতে থেকে ইরানের কৌশলী অবস্থানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই৷ ইরান অনেকটা সেই কৌশল অবলম্বনই করার চেষ্টা করছে ইউক্রেনকে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে৷
ইরান একবারের জন্যও রাশিয়ার সামরিক অভিযানের সমালোচনা করেনি, তবে যুদ্ধ বা সামরিক অভিযান যে সমস্যার সমাধান নয়- সে কথা বলেছে, বার বার বলছে৷ কূটনৈতিক উদ্যোগের তাগিদ দিচ্ছে৷ ইরানের এই তাগিদের সাথে চীনের বক্তব্যের সামঞ্জস্য পাওয়া যায়৷ চীনও বলছে, আলোচনার মাধ্যমে এই পরিস্থিতির সমাধান করা হোক, চীন আলোচনায় মধ্যস্থতা বা কোনো ধরনের ভূমিকা রাখার আকাঙ্খাও প্রকাশ করেছে৷ ইরান আবার বর্তমান যুদ্ধপরিস্থিতির জন্য ন্যাটোকেই দায়ী করছে৷ ন্যাটোর সম্প্রসারণ উদ্যোগ স্বাধীন আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে বলে উল্লেখ করছে, যা আসলে রাশিয়ার বক্তব্যেরই প্রতিধ্বণি৷
ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সরকারের অবস্থান যা-ই হোক না কেন আরব দেশগুলোর কোথাও যুদ্ধবিরোধী বড় ধরনের কোনো বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ হতে দেখা যায়নি৷ পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় এবং নিজ নিজ অঞ্চলের দীর্ঘদিনের বিবাদজনিত প্রতিক্রিয়া তাদের ইউক্রেন নিয়ে প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত রেখেছে৷ সরকারগুলোও সরাসরি প্রকাশ্যে কোনো পক্ষ হয়ে উঠতে চাচ্ছেন না৷ ফলে রাশিয়াবিরোধী পশ্চিমা জোটের দুনিয়া হাঁকানো লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্য অনেকটা ‘‘এটা আমাদের বিষয় না’’ অবস্থান নিয়েই থাকতে চাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে৷