এ যুগে ইউরোপ প্রবাসী ভারতীয়দের বিয়ে
১১ জুলাই ২০২২‘‘আমি তিন মাসের মধ্যে বিয়ে করতে চাই৷ আমার একটা বউ দরকার৷ প্লিজ, আমাকে সাহায্য করুন!''- এমন অনুরোধ প্রায়ই পেয়ে থাকেন মালাইকা নেরি৷ পেশাদার ম্যাচমেকার, অর্থাৎ ঘটক হিসেবে ইউরোপে একটা প্রতিষ্ঠান চালান৷ সেই সুবাদে সব শ্রেণি-পেশার মানুষেরই জীবনসঙ্গী খুঁজে দেয়া তার কাজ৷ ভারতের মুম্বাইয়ে জন্ম নেয়া মালাইকার খদ্দেররাও মূলত ভারতীয়ই৷ তো তিন মাসে বিয়ে করতে হবে, তাড়াতাড়ি একটা বউ চাই- এমন আহ্বানও প্রবাসী ভারতীয়রাই জানান তাকে৷
এমন আহ্বান জানানো মানুষগুলো কিন্তু কম শিক্ষিত বা কম ‘আধুনিক' নন৷ কেউ প্রকৌশলী, কেউ আইটি বিশেষজ্ঞ, কেউ বা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের কনসাল্ট্যান্ট বা প্রজেক্ট ম্যানেজার৷ জীবনবৃত্তান্ত ঘেঁটে দেখা যায় প্রত্যেকেই দীর্ঘদিন ধরে থাকছেন ইউরোপে৷ তারপরও জীবনসঙ্গী বেছে নেয়ার বেলায় তারা যেন অসহায়৷ এ কারণে বিয়ে বা যৌথজীবন শুরুর সময় এলেই অন্যের দ্বারস্থ হতে হয় তাদের৷
এমনিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব বা প্রতিবেশী, অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পাত্র বা পাত্রী নির্বাচনের চল বহু যুগের৷ তবে হালে প্রবাসী ভারতীয়দের বড় একটা অংশ সেই নিয়ম ভেঙে মালাইকা নেরির মতো ম্যাচমেকারদের মাধ্যমে জীবনসঙ্গী বেছে নিচ্ছেন৷
উচ্চ শিক্ষিত প্রবাসী ভারতীয়দের চাহিদার কথা মাথায় রেখে অনলাইন ম্যাচমেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন কাজের কৌশল সময়ের সাথে সাথে বদলাচ্ছে৷ পরিবার বা সমাজের চেয়ে তাই পাত্র-পাত্রীদের চাওয়া-পাওয়াই পাচ্ছে বেশি গুরুত্ব৷ ফলে পাত্র বা পাত্রী তার সঙ্গীকে নিজের মতো করে, আরো ভালো করে জানার সুযোগ পাচ্ছেন৷
এ কারণে গত দুই দশকে ভারতীয় সমাজে ম্যাচমেকিং, অর্থাৎ ঘটকালি পেশা হিসেবেও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে৷ ম্যাচমেকারদের গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম দৃষ্টান্ত নেটফ্লিক্স-এর ‘ইন্ডিয়ান ম্যাচমেকিং' সিরিজ৷ ম্যাচমেকার সীমা আন্টিকে সেখানে কী সফলভাবেই না যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয়দের জীবনে বিয়ের ফুল ফোটাতে দেখা যায়!
মালাইকা নেরি অবশ্য মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয়দের চেয়ে ইউরোপে বসবাসরত বেশিরভাগ ভারতীয়ই একটু আলাদা৷ ইউরোপ প্রবাসী ভারতীয়দের অনেকেই এসেছেন ভারতের ছোট ছোট শহর থেকে৷ তাদের অনেকের পরিবারের কেউ আগে কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েননি৷ এ ধরনের পরিবারে এখনো ‘অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ'-এর চল বেশি বলেও মনে করেন মালাইকা৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘তাদের অনেকের কাছে ডেটিং এখনো ট্যাবু৷ অনেকের ইউরোপের তরুণ-তরুণীদের মতো কোনো ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে দেখা করা এবং ডেটিং করার অভিজ্ঞতাও নেই৷ এ কারণে তাদের জন্য হঠাৎ করে স্টকহোম বা লন্ডনের মতো জায়গায় একজন সঙ্গী খুঁজে নেয়া খুবই কঠিন৷''
এখনো ‘অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ'
এই কঠিন কাজটি জার্মান প্রবাসী ভারতীয়রা কিভাবে করছেন তা জানার চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন বেশ কিছু পরিবারের কাছ থেকে সাড়াও পাওয়া গেছে৷
সেই সুবাদে জানা গেছে রেশমির (ছদ্মনাম) নাটকীয়ভাবে ভারত থেকে বিয়ে করে জার্মানিতে চলে আসার গল্প৷
রেশমির বরের পরিবার প্রায় ৬০ বছর ধরে জার্মান প্রবাসী৷ পছন্দের কনে নিজেদের পক্ষে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব বলে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা আনন্দবাজারে ‘পাত্রী চাই' বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন তারা৷ সেই বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে রেশমির মায়ের৷ ব্যস, তারপরই দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ এবং চট জলদি বিয়ে করে রেশমির জার্মানিতে আগমন৷
রেশমি জানান, এমন গল্প তার পরিচিত গণ্ডিতে অনেক আছে৷ তবে ডয়চে ভেলে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, তাদের অধিকাংশই জানিয়েছেন, তাদের বিয়ের ঘটকের কাজটি পরোক্ষভাবে করেছে ভারতীয়দের জন্য বিশেষায়িত কিছু ম্যাট্রিমোনিয়্যাল ওয়েবসাইট৷
সেরকমই এক ওয়েবসাইট ভারত ম্যাট্রিমোনি৷ বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ভাষার শাখা আছে তাদের৷ কেরালার প্রীতি (ছদ্মনাম) জার্মান প্রবাসী ভারতীয় পাত্র খুঁজে পেয়েছেন ভারত ম্যাট্রিমোনির শাখা কেরালা ম্যাট্রিমোনির সাহায্যে৷ আগ্রহী সব পানিপ্রার্থীর মতো প্রীতিও নিজের প্রোফাইল দিয়েছিলেন সেখানে৷ তারপর এক অর্থে তার ‘স্বপ্নের রাজকুমার'কে খুঁজে পেতে কোনো সমস্যাই হয়নি প্রীতির৷
মালাইকা নেরি জানান, ভারতীয় পরিবারে নির্দিষ্ট সময়ে বিয়ে করা এবং সন্তানের জনক-জননী হওয়ার চাপ থাকে বলেও তার সহায়তার জন্য মরিয়া হয়ে ‘‘আমি তিন মাসের মধ্যে বিয়ে করতে চাই৷ আমার একটা বউ দরকার৷ প্লিজ, আমাকে সাহায্য করুন!''- অনুরোধ জানান অনেকে৷
কিন্তু তাদের চাহিদা পূরণ করা অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ৷ বিশেষ করে পরিবারের পক্ষ থেকে যখন সন্তানকে যে করেই হোক নিজের ধর্ম, গোত্রের মধ্যে বিয়ে করার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়, তখন মিল-মতো সঙ্গী পাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে৷
ভারতীয় বিয়ের বাজার
গুগল এবং কেপিএমজি কনসালটেন্সির এক সমীক্ষা বলছে, গত পাঁচ বছরে ভারতীয়দের অনলাইন বিয়ের বাজার দ্বিগুণেরও বেশি বড় হয়েছে৷ তার বাজার মূল্য এখন ২৬০ মিলিয়ন ডলার বা ২৫৫ মিলিয়ন ইউরো৷ মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, আজকাল মানুষ নিজের কাজে এত বেশি সময় ব্যয় করতে বাধ্য হন যে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য তেমন কোনো ফুরসতই থাকে না৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সময়ের সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে একসময় তাকে আউটসোর্সিং করতে হয়, এক্ষেত্রে সম্পর্ক তৈরিও...৷''
শবনম সুরিতা/এসিবি