আমি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মেয়ে৷ সেখানকার মেয়েরা ছোটবেলা থেকে অনেকটাই আত্মনির্ভরশীল৷ আশেপাশে এমন উদাহরণ দেখেই বড় হয়েছি৷ বেড়িয়ে পড়ার নেশা রয়েছে সেই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে৷ আমার বাবা এই নেশাটা আমার মধ্যে ঢুকিয়েছিলেন৷ কিন্তু উনি বড্ড দ্রুত চলে যাওয়ায় ঘোরাঘুরির স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে যায় কলেজ পর্যন্ত৷ এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে থাকাকালে পরিচয় হয় বিভিন্ন এলাকার মেয়েদের সাথে৷ আদান-প্রদান হয় সংস্কৃতি, ভাষা আর খাওয়া দাওয়ার৷ এই সুযোগে বন্ধুত্ব এবং তাদের বাড়িতে যাওয়া, অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরার সুযোগ হয়৷ কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে কখনোই একা কোনো পর্যটন স্থানে যাওয়ার চিন্তাও মাথায় আসেনি৷ মেয়েদের হলের গেট যেখানে ৯টায় বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে বুঝতেই হবে আমাদের দেশে মেয়েদের নিরাপত্তার হাল কী! যারা দেশে থাকেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন ভ্রমণে নিরাপত্তা আর টয়লেট এই দুটো নারীদের জন্য এখনও দুরাশা৷ তাই এবার একটু ইউরোপের কথায় আসি৷
ঢাকায় সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে যখন জার্মানিতে এলাম, তখন একেবারেই একা, প্রথমবারের মতো৷ তাই প্রথম প্রথম একা একা সন্ধ্যাবেলা বেড়োতেও ভয় পেতাম৷ পরে সহকর্মীদের আশ্বাসে বাড়ির আশেপাশে সন্ধ্যার পরেও হাঁটতে বের হই, এক সময় তা অভ্যাসে পরিণত হলো৷ ভয় কেটে গেল৷ জার্মানিতে এসেই এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে ব্রেমেনে গেলাম ট্রেনে চেপে ঠিক দুই দিনের মাথায়৷ টিকেট কাউন্টারে গিয়ে টিকেট কেটে নিলাম৷ সিট বুকিংয়ে একটা বাড়তি চার্জ দিতে হয়, সেটা না নিলে ফাঁকা যেকোন সিটে বসা যায়৷ তাই তেমন একটা সিটে বসে রওনা দিলাম ব্রেমেন, যেতে লাগলো প্রায় ৪ ঘণ্টা৷ কী ঝকঝকে ট্রেন, কী পরিষ্কার টয়লেট! কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না, কেউ জোরে কথা বলছে না৷ এখানে মেয়ে হিসেবে কেউ আপনার দিকে বিশেষভাবে তাকাচ্ছে না৷ কী যে একটা স্বস্তি!
ফেরার পথে আমার বন্ধু বললো ট্রেনে অনেক ভাড়া বেশি, কারণ, আমি যেহেতু অনেক আগে টিকেট কাটিনি, তাই ও বললো ‘‘ব্লা ব্লা কার বুক করে দেই এটাতে করে যা, অনেক সস্তা৷'' আমি বললাম, ‘‘এটা কী জিনিস?'' বুঝিয়ে বললো, এটা কার শেয়ারিংয়ের মতো, একটা অ্যাপে গিয়ে বুক করতে হয়৷ কেউ একজন বন-এ যাচ্ছে, একা যাচ্ছে, সাথে আমিও সঙ্গী হলাম, সে কিছু টাকাও পেলো৷ আমার মনটা একটু খুঁত খুঁত করছিল, কিন্তু ও বললো ওর অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে ভালো৷ ভোর ৪টায় বাস স্টপে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো৷ চালক একজন পুরুষ৷ তিনি নাম বিনিময় করলেন, বললেন ইচ্ছে হলে আমি পেছনের সিটেও বসতে পারি৷ আমি অভদ্রতা হবে ভেবে পাশেই বসলাম৷ এরপর তিনি আমার পছন্দের গান ছেড়ে গাড়ি ছেড়ে দিলেন, পথে একবার বিরতি নিয়ে আমরা কফি খেলাম এবং টয়লেটে গেলাম৷ বলাবাহুল্য, ছেলে এবং মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট এবং ভীষণ পরিষ্কার৷ সকাল সকাল বন শহরে পৌঁছে গেলাম৷ এই একটা ঘটনায় আমার অনেক ভীতি এবং সংকোচ ও দ্বিধা দূর হয়ে গেল৷
আর একটা ঘটনা বলি৷ ২০১৪ সালে বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখতে কোলন শহরে এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম৷ সেবার শিরোপা জেতে জার্মানি৷ রাস্তাঘাটে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন সবাই৷ খেলা শেষে খাওয়া-দাওয়া করে বের হতে বেশ রাত হয়ে যায়৷ কেবল হৈ-হুল্লোড় নয়, তখন হাতে হাতে সবার বিয়ার বা পানীয়ের বোতল৷ উদযাপন চলছে৷ সবারই প্রায় টালমাটাল অবস্থা! এ অবস্থায় ট্রেন স্টেশনে যখন পৌঁছালাম অনেক মানুষ৷ ট্রেনে সবাই চিৎকার করে গান করছে, পান চলছে৷ ট্রেন চলতে শুরু করলো৷ কিন্তু কেউ আপত্তিকর কোনো কথা বলল না, বাজেভাবে স্পর্শ করা তো দূরের কথা৷
এরপর একবার ভোর ৫ টায় ফ্লাইট ধরবো৷ বাস ধরে যেতে হবে এয়ারপোর্টে৷ রাত ২টায় রাস্তায় বেরিয়েছি৷ জনমানবশূন্য পুরো এলাকা৷ হেঁটে চলেছি৷ হঠাৎ দেখি একটা বাইক আসছে বেশ জোরে৷ কাছে আসতে দেখি- পুলিশ৷ অনেকটাই নিরাপদবোধ করলাম৷ রাতের বেলায় পুলিশ টহল দিচ্ছে- যদি কোথাও কোনো ঘটনা ঘটে!
বাস স্টপে দাঁড়ালাম দুরুদুরু বুকে৷ নাইট বাস কী সত্যিই আসবে? যথা সময়ে বাস এসে হাজির৷ বাসে মাত্র একজন যাত্রী৷ ভোরের ফ্লাইটগুলো সস্তায় হয় দেখে বহুবার এমন রাতে ভ্রমণ করতে হয়েছে, কিন্তু কখনো কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি৷
পুরো ইউরোপে আপনি যেখানেই ঘুরতে যান না কেন ট্রেন স্টেশন, রেস্তোরাঁ, ক্যাফে থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে নারীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা আছে৷ টয়লেটে স্যানিটারি প্যাড ফেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে৷ আর বেশিরভাগ বড় ট্রেন স্টেশনে যেসব দোকান থাকে তার মধ্যে অন্তত একটা দোকান আছে, যেখানে আপনি স্যানিটারি প্যাড কিনতে পারবেন৷ ফলে মেয়েরা এখানে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করতে পারেন৷ ভ্রমণের সময় আপনি যদি নিরাপদ বোধ না করেন, তাহলে বাস, ট্রাম বা ট্রেনে ফোন করার জন্য নির্দিষ্ট নাম্বার দেয়া থাকে, সেই নাম্বারে ফোন করলে তাৎক্ষণিত সহায়তা পাওয়া সম্ভব৷
আমার মা বেশ কয়েকবার জার্মানি এসেছেন এবং তাকে নিয়েও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে ভ্রমণ করেছি৷ একবার ডেনমার্ক থেকে বন-এ ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়৷ ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি ট্রামের, এক সময় একজন গৃহহীন মাতাল মা'র সামনে এসে হাত পা নেড়ে চিৎকার করতে থাকে....মা খুব ভয় পেয়ে যান৷ আমি তাকে আশ্বস্ত করি, যতই হৈ হুল্লোড় করুক ভয় পাওয়ার কিছু নেই৷ একটা সময় নিজে থেকেই চলে যায়৷ প্রথমবার জার্মানি এসে অনেক রাতে বের হওয়া, অচেনা জায়গায় বেড়াতে যাওয়া এটা মা'র কাছে একটু ভীতির ছিল৷ ভাবতো আমি কী করে সব ঠিকঠাক চিনে যেতে পারবো, হোটেল বা অ্যাপার্টমেন্ট কীভাবে খুঁজে পাবো, সেটা নিরাপদ হবে কিনা? কিন্তু এখন মা ঠিক জানে এখানে নিরাপত্তার কোনো অভাব নেই৷ যাত্রাপথে টয়লেটে যাওয়া তার প্রধান সমস্যা৷ এমন নয় যে ডায়াবেটিস আছে৷ কিন্তু দেশে বাসে চলাফেরা করলে তার মূল চিন্তা থাকে টয়লেট নেই এবং সেই দুশ্চিন্তা তলপেটে চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়৷ এখানে বাস, ট্রেনে ভ্রমণে তাই তিনি নিশ্চিন্তে সফর করেন৷ এখন কোথায় যাচ্ছি, কোথায় থাকবো, এসব নিয়ে আর প্রশ্ন করেন না৷ তার বক্তব্য, ইউরোপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটলেও তার ক্লান্তি লাগে না৷ ট্রামে, বাসে ভিড় থাকলে অল্পবয়সিরা উঠে তার জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়, এটাও তাকে বিস্মিত করে৷ তবে একটা বিষয়েই তাকে কেবল বিরক্ত হতে দেখেছি, যে-কোনো যাত্রায় জার্মান সহযাত্রী যখন সজোরে নাক ঝাড়েন, উনি এটা নিতে পারেন না (যাদের এ অভিজ্ঞতা আছে তারাই বুঝবেন ব্যাপারটা)!
এবার বলি সন্তান ছোট থাকলে পরিবারের জন্য ইউরোপে ভ্রমণ কতটা সহজ৷ ইউরোপে ট্রেনে ভ্রমণ সবচেয়ে আরামদায়ক, বিশেষ করে সন্তান যদি ছোট থাকে৷ এখানকার ইন্টারসিটি এবং দ্রুতগতির ট্রেনগুলোতে ফ্যামিলি কেবিন আছে৷ অর্থাৎ, একটা কেবিন শুধু আপনার পরিবারের জন্য বুক করতে পারেন৷ এই কেবিনের সুবিধা হলো এটি ছোটখাটো একটা ঘরের মতো, দরজা দিয়ে আলাদা করা, আপনি ইচ্ছেমতো লাইট অন-অফ করতে পারেন, স্পিকারের সাউন্ড কমাতে বাড়াতে পারেন, অর্থাৎ, ট্রেন কোথায় থামছে, কী সমস্যা এসব বার্তায় যদি আপনার সন্তানের ঘুমের সমস্যা হয়, তাহলে তা অফ করে দিতে পারেন৷ আর এসব কেবিনের পাশেই থাকে টয়লেট৷ ফলে শিশুকে টয়লেটে নিয়ে যাওয়া বা ডায়পার বদলানোর কাজটাও সহজ হয়৷ আর জার্মানির দ্রুতগতির ট্রেন আইসিইতে টিকেট চেক করার সময় টিটি শিশুদের জন্য একটা বাড়তি টিকেট দেন, যেটাকে বলে, ‘কিন্ডারকার্টে'৷ ট্রেনের রেস্তোরাঁয় গিয়ে এই টিকেট দেখালে খেলনা ট্রেন পাওয়া যায়, পাশাপাশি জার্মানির ট্রেন নিয়ে মজার বই পাওয়া যায়৷ এই খেলনা নিয়ে খেলতে খেলতে এবং বই পড়তে পড়তে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে শিশু৷
রেস্তোরাঁয় নানারকম মেন্যুর মধ্যে ‘কিডস মেন্যু' বা শিশুদের খাবারও আছে, আছে নানা চকলেট জুস৷ তবে রিজিওনাল ট্রেন যেগুলো সেগুলোতে এই বাড়তি সুবিধাগুলো না থাকলেও টয়লেটের সুবিধা প্রত্যেকটা ট্রেনেই আছে, যেটা নারী এবং শিশুদের জন্য ভীষণ জরুরি৷
এবার আসি গাড়িতে ভ্রমণ৷ এখানে নিজের গাড়ি নিয়ে অনেক মেয়েই ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন, অনেকে আবার গাড়ি ভাড়া নেন৷ পথে নির্দিষ্ট দূরত্বে গ্যাসস্টেশনগুলোতে টয়লেটের ব্যবস্থা আছে এবং আছে স্ন্যাকস, কফি, অন্যান্য পানীয়, সিগারেট ইত্যাদির দোকান৷ আমার পরিচিত জার্মান ও পোলিশ বান্ধবীর কাছে শুনেছি তারা বহুবার কেবল নারীরা মিলে ক্যাম্পিং করেছেন জঙ্গলে বা পাহাড়ের পাদদেশে৷ কিন্তু কখনো কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনার মুখোমুখি হননি৷
ইউরোপে বাসযাত্রাও নারীদের জন্য স্বস্তিকর৷ আমি নিজে ১৭-১৮ ঘণ্টা টানা ভ্রমণ করেছি৷ দূরপাল্লার বাসগুলোতে টয়লেট আছে৷ তাই পিরিয়ডের সময়ও নির্দ্বিধায় নারীরা বাসে ভ্রমণ করতে পারেন৷
নারীদের জন্য বিমানযাত্রার ক্ষেত্রে হয়ত বাংলাদেশ আর ইউরোপে খুব একটা পার্থক্য আছে বলে আপনাদের মনে হবে না৷ তবে ছোট শিশু আছে এমন পরিবারের জন্য কিন্তু ইউরোপের বিমানবন্দরগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা আছে৷ বিমান ওড়ার সময় ঝাঁকুনি কম লাগে বা অস্বস্তি কম হয় এমন কিছু নির্দিষ্ট সিট শিশুদের জন্য বরাদ্দ থাকে৷ তার আশেপাশে আপনার সিট নির্ধারণ করার জন্য বলা হয়৷ নিরাপত্তা তল্লাশির ক্ষেত্রে গর্ভবতী মা এবং ছোট শিশু আছে এমন যাত্রীদের প্রাধান্য দেয়া হয়৷ আপনি যদি গর্ভবতী অবস্থায় সিকিউরিটির স্ক্যান মেশিনের মধ্য দিয়ে যেতে না চান, সেটা জানালে আপনার সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়৷
আসলে পুরো বিশ্বে প্রত্যেক দেশে সব মানুষের জন্য ভ্রমণ নিরাপদ আর স্বস্তির হওয়া উচিত৷ ভ্রমণের সময় যদি নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, শারীরিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে হয় তাহলে তার ভ্রমণের আনন্দই মলিন হয়ে যায়৷