ইকুয়েডর আর সন্দেহ - প্রথম দিনে কাতারের দুই প্রতিপক্ষ
২১ নভেম্বর ২০২২৯২ বছর আগে বিশ্বকাপের প্রথম আসরআর এবারের আসরের প্রথম দিনটার কত অমিল! ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল যখন শুরু হয়, তখন অনেক দেশ আসরে অংশই নিতে চায়নি। ৯২ বছর পর, আয়োজক বাদে ৩১ টা জায়গার জন্য বাছাইপর্বে অংশ নেয় ২০৬টা দল! আয়োজনের ব্যfপ্তি ও ব্যfপকতা যেমন বেড়েছে, তেমনি আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে খানিকটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মাঠের ফুটবল।
কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ খেলবে স্বাগতিক কাতার এবং ইকুয়েডর। স্বাগতিকদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের মুহূর্ত, মধ্যপ্রাচ্যের ছোট অথচ ধনী দেশ কাতার এই মুহূর্তের জন্যই তো খরচ করেছে কোটি কোটি ডলার। ১ এপ্রিল হয়ে যাওয়া বিশ্বকাপের ড্র অনুষ্ঠানেই জানা হয়ে যায়, উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক কাতার খেলবে লাতিন আমেরিকার বাছাই অঞ্চলের চতুর্থ হওয়া দল ইকুয়েডরের বিপক্ষে। উদ্বোধনী ম্যাচে যেহেতু অনেক রকম আনুষ্ঠানিকতা থাকে, তাই এই ম্যাচের টিকেটের দাম ও চাহিদা দুইই বেশি হয়। কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচের টিকিটের সর্বনিম্ন অফিসিয়াল দাম ৫৪ ডলার বা ২০০ কাতারি রিয়াল। প্রশ্ন হচ্ছে, বছরের অন্য কোনো সময়ে হলে কি এই ম্যাচের জন্য এই পরিমাণ অর্থ খরচ করতেন ফুটবল দর্শকরা?
শুধু এবারের আয়োজনেই নয়, বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের পরের বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার নিয়মটা বাদ দেবার পর থেকেই আসলে উদ্বোধনী ম্যাচ রঙ হারিয়েছে। প্রথম বিশ্বকাপে তো অংশগ্রহণের জন্য ১৬টা দলই হয়নি, উদ্বোধনী দিনে একই সঙ্গে হয়েছিল ফ্রান্স-মেক্সিকো আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বেলজিয়াম এই দুটো ম্যাচ। প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে বয়কটই করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বকাপ, কারণ, আগের বার ইউরোপের চার বড় দল আসেনি লাতিন আমেরিকায়! ১৯৩৪ বিশ্বকাপে শুরু থেকেই নকআউট পর্ব, ২৭ মে তারিখে একসঙ্গে আট ভেন্যুতে আট ম্যাচ, তাই ছিল না উদ্বোধনী ম্যাচের আনুষ্ঠানিকতা।
১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপ থেকেই আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন ও স্বাগতিকদের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। ২০০২ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত আগের আসরের চ্যাম্পিয়নের সরাসরি খেলার সুযোগ ছিল, যেটা পরের বিশ্বকাপ থেকে রদ করা হয়। ফ্রান্সে হওয়া সেই বিশ্বকাপেও সেই অর্থে কোনো উদ্বোধনী ম্যাচ ছিল না, ৪ জুন খেলেছিল সুইজারল্যান্ড-জার্মানি আর পরদিন ৭টা নকআউট ম্যাচে বাকি ১৪ দল হয়েছিল মুখোমুখি।
দুই বিশ্বযুদ্ধে ১২ বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৫০ সালে ফের শুরু হলো বিশ্বকাপ। নানান রাজনৈতিক সমীকরণের মারপ্যাঁচে শেষ পর্যন্ত মাত্র ১৩টি দল অংশ নিয়েছিল এই বিশ্বকাপে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন তখনো পুনর্গঠিত হয়নি, জাপান তখনো অধিকৃত আর ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে আসেনি আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর আর পেরু। নতুন করে শুরু হওয়া বিশ্বকাপে উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক ব্রাজিল নেমেছিল নতুন বানানো মারাকানা স্টেডিয়ামে। তখন মারাকানা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দর্শকধারণক্ষমতার স্টেডিয়াম আর প্রথম দিনেই ব্রাজিল-মেক্সিকোর দ্বৈরথ দেখতে মাঠে গিয়েছিল ৮১ হাজার দর্শক!
পরের বিশ্বকাপটা ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ডে, সেবারও উদ্বোধনী ম্যাচ নিয়ে বাড়তি কোনো আয়োজন নেই। ১৬ জুন আসর শুরু হয়, এই তারিখে ৩ ভেন্যুতে ছিল ৩টি ম্যাচ। প্রথম তারিখে খেলা ছিল আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ের। ১৯৫৮'র সুইডেন বিশ্বকাপেও ৪ গ্রুপের প্রথম খেলা ছিল প্রথম দিনে, তারিখটা ৮ জুন। ১৯৬২'র চিলি বিশ্বকাপেও তাই। প্রথা ভাঙলো বা নতুন রীতির শুরু হলো ১৯৬৬'র ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে। ১১ জুলাই শুরু হলো বিশ্বকাপ, প্রথম দিন শুধুই ইংল্যান্ডের খেলা, সেদিন ওয়েম্বলিতে ববি মুরের দলের প্রতিপক্ষ ছিল উরুগুয়ে। ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপেও তাই, উদ্বোধনী দিনে শুধুই স্বাগতিকদের ম্যাচ। ৩১ মে মেক্সিকো-সোভিয়েত ইউনিয়ন ম্যাচ দিয়ে আসর শুরু, পরের ম্যাচগুলো জুনের ২ তারিখ থেকে। ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল আর যুগোস্লাভিয়া মুখোমুখি হয়েছিল, স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানি প্রথম ম্যাচ খেলেছিল পরের দিন। ১৯৭৮-এর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে মাঠে নেমেছিল আগের আসরের বিজয়ী পশ্চিম জার্মানি, প্রতিপক্ষ ছিল পোল্যান্ড। স্বাগতিক আর্জেন্টিনা প্রথম ম্যাচ খেলেছিল পরের দিন। ১৯৮২'র স্পেন বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে মাঠে নেমেছিল আগের আসরের বিজয়ী আর্জেন্টিনা,স্পেনের প্রথম ম্যাচ ছিল দুই দিন পর। ১৯৮৬'র মেক্সিকো বিশ্বকাপেও আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন ইতালির ম্যাচ দিয়েই শুরু হয়েছিল আসর, ১৯৯০ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে মাঠে নেমেছিল আগের আসরের বিজয়ী আর্জেন্টিনা। প্রথম ম্যাচেই ডিয়েগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দিয়েছিল আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন!
১৯৯৪'র বিশ্বকাপের আয়োজক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হলিউডি কায়দায় জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, অপরাহ উইনফ্রের উপস্থাপনা আর ডায়ানা রসের গানে মনমাতানো অনুষ্ঠানের পর বিল ক্লিনটনের হাতে উদ্বোধন হয় 'সকার বিশ্বকাপ'-এর। শুরুর ম্যাচটা ছিল জার্মানি-বলিভিয়ার। ১৯৯৮'র ফ্রান্স বিশ্বকাপেও উদ্বোধনী ম্যাচটা ছিল আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের সঙ্গে স্কটল্যান্ডের।
২০০২ সালে প্রথম বিশ্বকাপএশিয়ার মাটিতে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। '৯৮র শিরোপাজয়ী ফ্রান্স বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেই হোঁচট খেলো সেনেগালের কাছে, এরপর কোনো ম্যাচ না জিতেই বিদায় নিলো গ্রুপপর্ব থেকে। 'শিরোপার অভিশাপ'-এর শুরু এখান থেকেই। ২০০৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব থেকেই আগের আসরের চ্যাম্পিয়নদের পরের বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার নিয়ম তুলে দেয়া হয়, তাই ২০০২-এর বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলকেও অংশ নিতে হয় বাছাইপর্বে। সূচি তৈরির সময় স্বাগতিক দলকে ধরা হয় 'এ ওয়ান', শীর্ষ বাছাই ৭ দলের সঙ্গে রাখা হয় স্বাগতিকদের। ড্রতে এই দলের সঙ্গে র্যাংকিং অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে ৮টি করে দলের অন্য তিনটা পাত্র থেকে দল নিয়ে গ্রুপ সাজানো হয়। যেহেতু একমাত্র স্বাগতিক দেশ ছাড়া কোনো দলেরই অংশগ্রহণ নিশ্চিত নয়, তাই ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকেই উদ্বোধনী ম্যাচটা রাখা হয় স্বাগতিক দেশের। এই ধারাবাহিকতাতেই ২০০৬ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ হয় জার্মানি-কোস্টারিকা, ২০১০ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকা-মেক্সিকো, ২০১৪তে ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া, ২০১৮তে রাশিয়া-সৌদি আরব আর ২০২২ বিশ্বকাপে এসে হতে যাচ্ছে কাতার-ইকুয়েডর।
আয়োজক দেশ যদি ফুটবল শক্তিতে পিছিয়ে না থাকে, তাহলে বৈশ্বিক দর্শকদের জন্য খুব একটা অসুবিধা হয় না। যেমনটা দেখা গেছে ২০০৬ এবং ২০১৪তে। কিন্তু আয়োজক দেশ যদি অর্থ আর সংগঠনে শক্তিশালী হয়ে মাঠের খেলায় পিছিয়ে থাকে, তাহলেই উদ্বোধনী ম্যাচটা আকর্ষণ হারায়, কারণ, ম্যাচটা হয় সাধারণ এ গ্রুপের এক নম্বর দলের সঙ্গে চার নম্বর দলের। কাতারের ফিফা র্যাংকিং ১৩৯, ইকুয়েডরের ৪৪। অথচ স্বাগতিক হওয়ার জন্যই এ গ্রুপের শীর্ষ দল হিসেবে প্রথম ম্যাচটা খেলছে তারা, যেখানে বাকি ৭ গ্রুপের শীর্ষ দল হচ্ছে ফিফা র্যাংকিংয়ের প্রথম ৭টা দল।
কাতারকে বিশ্বকাপের আয়োজক করা নিয়ে দুর্নীতির জের ধরে ফিফায় গদি নড়েছে সেপ ব্ল্যাটারের। ফরাসি কিংবদন্তী ফুটবলার মিশেল প্লাতিনিকেও দুর্নীতির দায় নিয়ে বিদায় নিতে হয়েছে, গায়ে মাখতে হয়েছে কলঙ্ক। পেট্রো-ডলারের জোরে জুন-জুলাইয়ের বিশ্বকাপ নিয়ে যাওয়া হয়েছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে, যখন ইউরোপের ক্লাব ফুটবল মৌসুমের মাঝামাঝি সময়। এত কিছুর পর বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ মাঠে গড়ানোর আগে উঠে এসেছে আরেক কেলেংকারির খবর! মধ্যপ্রাচ্যের এক বুদ্ধিজীবি, আমজাদ তাহা দাবি করছেন প্রথম ম্যাচ জেতার জন্য কাতার নাকি ইকুয়েডরের খেলোয়াড়দের ঘুস দিয়েছে।
আমজাদ তাহা 'ব্রিটিশ মিডল ইস্ট সেন্টার ফর স্টাডিজ আ্যন্ড রিসার্চ' নামের একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক পরিচালক। সংস্থাটি মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করে, তাহা নিজে বেশ কিছু বই লিখেছেন, যার ভেতর 'দ্য ডিসেপশন অব দ্য আরব স্প্রিং' মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে তার একটি আলোচিত বই। এই মানুষটি টুইট করেছেন, ‘‘উদ্বোধনী ম্যাচে হারার জন্য ইকুয়েডরের ৮ ফুটবলারকে ৭.৪ মিলিয়ন ডলার ঘুস দিয়েছে কাতার। গোলটা হবে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে, ১-০ গোলে জিতবে কাতার। কাতারের দলের ভেতরের ৫ জন আর ইকুয়েডরের ১ জন এটা নিশ্চিত করেছে। আশা করছি এটা মিথ্যা হবে। গোটা পৃথিবীর উচিত ফিফার এই দুর্নীতির প্রতিবাদ জানানো।''
কাতারকে বিশ্বকাপেরস্বাগতিক করা নিয়ে ফিফায় যে দুর্নীতি হয়েছে সে তো স্পষ্টই হয়ে গেছে পরবর্তী সব পদক্ষেপে। এরই মধ্যে কাতারে ভুয়া সমর্থক, স্টেডিয়ামে বিয়ার নিষিদ্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় বহু শ্রমিকের মৃত্যু- এমন অনেক ব্যপার নিয়েই সমালোচনা চলছে, অনেক দেশ বিশ্বকাপ বয়কটের ডাকও দিয়েছে। ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ কতটা সত্যি তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, তবে স্বাগতিকদের এমন আচরণ নতুন নয়। ১৯৭৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনাকে তোলার জন্য পেরুর খেলোয়াড়দের হত্যার হুমকি দেয়ার মতো ভয়ানক অভিযোগ উঠেছিল আর্জেন্টাইন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেয়া, জাহাজভর্তি খাবার পাঠানোসহ আরো অনেক কিছুই নাকি হয়েছিল সেসময়ে।
১৯৭৮-এর বিশ্বকাপ নিয়ে ২০১৮ সালে 'এস্কয়ার' ম্যাগাজিন একটা প্রবন্ধ ছেপেছিল, যার শিরোনাম ছিল, 'ফিরে দেখা আর্জেন্টিনা ১৯৭৮, সবচেয়ে নোংরা বিশ্বকাপ'। ৪০ বছর পর কাতার বিশ্বকাপ নিয়েও এমন লেখার আশঙ্কা কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না!