ইব্রাহীমের কান্না থামাবে কে?
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ইব্রাহীমের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বাংলাদেশ অংশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামে৷ ছোট্ট একটা টিলার উপরে তাদের ঘর৷ ঘরের একপাশে বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত৷ আর তারপরেই কাঁটাতারের বেড়া৷ এই বেড়া বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারকে বিচ্ছিন্ন করেছে৷
ইব্রাহীমের বক্তব্য অনুযায়ী, গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি এই বেড়ার ওপাড় থেকে ছোঁড়া একটি মর্টার শেল এসে পড়ে তার বাড়ির ছোট্ট উঠোনের ঠিক যেখানে তার মা হোসনে আরা বেগম দুপুরের রান্না করছিলেন, সেখানে৷ মাটির চুলায় রান্না করতে পছন্দ করতেন তার মা৷
গোলার আঘাতে গুরুতর আহত হন৷ তবে তারপরও কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলেন তিনি৷ হাসপাতালে নিতে নিতে অবশ্য নিথর হয়ে পড়েন হোসনে আরা বেগম৷ আর ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান আরেক ব্যক্তি, আহত হয় কয়েকটি শিশুও৷
স্বাধীন রাষ্ট্রে মায়ের এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না ইব্রাহীম৷ ভিনদেশিরা তার মা-কে হত্যা করেছে বলে মনে করেন তিনি৷ ইব্রাহীম তাই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চান৷
তবে, বিচার কীভাবে হবে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই৷ বিষয়টি ঠিক জানেন না তার বড় ভাই মোহাম্মদ শফিউল আলমও৷ তিনি শুনেছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই ঘটনার বিচার চাওয়া হবে৷
তবে বিচার চাওয়ার প্রক্রিয়াটি সেখানকার কেউই সেভাবে জানাতে পারলেন না৷ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-র এক কর্মকর্তা টেলিফোনে জানালেন, তার কাছেও এই বিষয়ে কোনো তথ্য নেই৷ তবে তিনি জানিয়েছেন, নিহত হোসনে আরার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে৷
মোহাম্মদ ইব্রাহীম আক্ষেপের সুরে জানিয়েছেন, গোলার আঘাতে তার মা যখন গুরুতর আহত, তখন তাকে হাসপাতালে নিতে অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল৷ সেই অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া দিতে হয়নি৷ কিন্তু তার মায়ের মৃতদেহ বহন করে আনা অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া ১৫ হাজার টাকা গুণতে হয়েছে তাদের৷ পাশাপাশি আরো খরচ করতে হয়েছে৷ দরিদ্র এই পরিবারের পক্ষে এভাবে অর্থ খরচ করা সহজ ব্যাপার নয়৷
মোহাম্মদ ইব্রাহীম অভিযোগ করে বলেন, ‘‘মিয়ানমারে এই ঘটনা হচ্ছে অনেক আগে থেকেই৷ বিজিবি, প্রশাসনের লোক কোনো একটা মানুষকে সচেতন করে নাই যে, গোলাগুলি হবে, আপনারা বর্ডার সাইডে যারা আছেন সতর্ক হয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান৷ যদি ঐ কথাটা বলতো, আমরা নিরাপদ স্থানে চলে যেতাম৷ আমার মা মারা যেতো না এখানে৷''
ঘুমধুমের স্থানীয় কয়েকজন এমন অভিযোগও করেছেন যে, সীমান্তের ওপাড়ে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এবং জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গোলাগুলি শুরুর পর এ পাড়ের বিজিবির সদস্যরাও সরে গিয়েছিলেন৷
ইব্রাহীমদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই সীমান্তের কাছে দেখা গেল বিজিবির একটি নিরাপত্তা চৌকি৷ বিজিবির তিন সদস্য বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সেখানে৷ ছবি তুলতে চাইলে জানালেন, বুলেট প্রুফ ভেস্ট আর হেলমেট ছাড়া তাদের ছবি তোলা যাবে না৷
তারা যখন সেসব পরছিলেন, তখন জানতে চাই, স্থানীয়দের অভিযোগের বিষয়ে৷ বিজিবির এক সদস্য তখন জানান, গোলাগুলির সময় বাঙ্কারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা৷ তবে সীমান্তরক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা৷
সেই সদস্য এটাও জানালেন, তাদের উপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেই দায়িত্ব পালন করছেন তারা, অন্য কোনো বিষয়ে জানেন না৷
দায়িত্বটা কী জানতে চাইলে বললেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো৷
এখানে বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে বাংলাদেশি নিহতের ঘটনা নতুন নয়৷ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এমন ঘটনা মাঝেমাঝেই ঘটে৷ সেসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও ন্যায্য বিচার হয়েছে এমন ঘটনার কথা তেমন একটা শোনা যায় না৷
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তেও বাস্তবতা একইরকম হবে কিনা এক্ষুণি হয়ত বলা যাবে না৷ তবে যে সীমান্তে মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া গোলাগুলিতে হোসনে আর বেগমসহ একাধিক ব্যক্তির প্রাণ গেছে, সেখান থেকে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ, সৈনিক এবং সরকারি কর্মকর্তারা অবস্থান করছেন ইব্রাহীমদের বাড়ির কাছেই এক স্কুলে৷ বিজিবির কড়া নিরাপত্তায় সেখানে অবস্থান করছেন তারা৷ এমনকি সংবাদমাধ্যমকেও সুযোগ দেয়া হচ্ছে না মিয়ানমারের এই নাগরিকদের কাছে ভেড়ার৷
সীমান্তে গোলাগুলির দায়ে এসব ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করা নিয়ে দৃশ্যত বাংলাদেশের বিশেষ মাথাব্যথা আছে বলে মনে হচ্ছে না৷ তাদেরকে শুধু নিজ দেশে ফেরত পাঠানো নিয়েই কথা বলছেন দায়িত্বশীলরা৷
ইব্রাহীমের আশা, সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়াতে আরও সচেতন হবে বাংলাদেশ৷ সেটা করলে তার মতো আর মা-হারা হতে হবে না অন্য কাউকে৷