ইভিএম নিয়ে অনড় নির্বাচন কমিশন
২৩ নভেম্বর ২০১৮বাংলাদেশে এর আগে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে৷ তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবারই প্রথম ইভিএম ব্যবহার করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন৷ তফসিল ঘোষণার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা জানিয়েছিলেন, শহরাঞ্চলের কিছু ভোট কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হবে৷ তবে ইভিএম-এর বিরোধিতা করে আসছে বিএনপি'র প্রাধান্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ আরো কিছু রাজনৈতিক দল৷ বিএনপি'র উদ্যোগে ঢাকায় বৃহস্পতিবার এ নিয়ে একটি সেমিনারও হয়৷ সেখানে তারা দাবি করেন ইভিএম-এর মাধ্যমে ভোটে কারচুপি সহজ৷ আর আওয়ামী লীগকে কারচুপির সুবিধা করে দিতেই ইভিএম ব্যবহারে অনঢ় রয়েছে নির্বাচন কমিশন৷ তারা সেখানে একটি ভিডিও ডেমোনস্ট্রেশন করে৷
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয়টি আসনের সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন৷ তবে ঠিক কোন ছয়টি আসনে ভোটগ্রহণ হবে তা দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে বাছাইয়ের পর ২৮ ডিসেম্বর ঘোষণা করা হবে বলে শনিবার জানিয়েছেন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ৷
বৃহস্পতিবার বিএনপির সেমিনারে দলটির তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম দাবি করেন, ‘‘ইভিএম-এ তিনভাবে কারচুপি হতে পারে৷ একটা নির্দিষ্ট সময় পর সব ভোট একটি প্রতীকে দেখানো সম্ভব৷ গণনার সময় কোনো একটি প্রতীকে ভোট বেশি দেখানো সম্ভব৷ আর তৃতীয় হলো আগে থেকেই ভোটের ফল নির্ধারণ করে দেয়া সম্ভব৷'' তবে কতটি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করলে তা ভোটের ফলাফলে প্রভাব ফেলবে তা স্পষ্ট নয়৷
বিএনপি'র নওগাঁ এলকার নেতা এবং বিএনপি থেকে নির্বাচন করার প্রত্যাশী ফজলে হুদা বাবুল বলেন, ‘‘ইভিএম একটি যন্ত্র এবং এর পিছনে মানুষ থাকে৷ তাই তিনি ইচ্ছে করলে এর মাধ্যমে ফল প্রভাবিত করতে পারবেন৷ আর বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষিত নয়৷ ফলে তাঁকে এর ব্যবহার বোঝানো এত সহজ নয়৷ ভারতেই এটা সফল হয়নি, বাংলাদেশে কিভাবে হবে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘এবার শহরাঞ্চলে ব্যবহার হবে৷ শহরাঞ্চলেও অধিকাংশ ভোটার শিক্ষিত নয়৷ তাঁরা বস্তিবাসী ও খেটে খাওয়া মানুষ৷''
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইভিএম ব্যবহারে কোনো সমস্যা নেই৷ কিন্তু সমস্যা এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে৷ কারণ, এটা অংশীজনদের সামনে দেখানো হয়নি৷ উন্মূক্ত করা হয়নি৷ এক্সপার্ট নিয়ে মূল্যায়ন করা হয়নি৷ এর গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা হয়নি৷''
তিনি বলেন, ‘‘এটা নিয়ে জনমত যাচাইয়ের ব্যবস্থাও হয়নি৷ তাছাড়া আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যে অনেক সমস্যা আছে৷ সেগুলো সংশোধন না করে ইভিএম কেন? ইভিএম-এর ব্যবহার আমাদের সেনাবাহিনীকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে, কারণ, তারা ইভিএম প্রক্রিয়ায় যুক্ত৷''
এরই মধ্যে ঢাকাসহ সব বিভাগীয় শহরে ইভিএম প্রদর্শনী করেছে নির্বাচন কমিশন৷ এটাকে ডেমোনস্ট্রেশন বলা যায় কিনা, জানতে চাইলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘‘এটা তো পাবলিক শো৷ সাধারণ মানুষ ওই শো-র মাধ্যমে কিভাবে এর সমস্যা বুঝবে? ওখানে এক্সপার্ট ও অংশীজনদের ডাকা হয়নি৷''
বৃহস্পতিবার সেমিনারে ইভিএম নিয়ে ডেমোনষ্ট্রেশন উপস্থাপনকারী বিএনপি'র তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম শুক্রবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইভিএম সোর্স কোডের মাধ্যমে চালিত হয়৷ এই সোর্স কোড পরিবর্তন করে দিলে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে এটা ব্যবহার করে ফলাফল পরিবর্তন করে দেয়া যায়৷ আর এটার ভিতরে একটা চিপ থাকে, এই চিপ পরিবর্তন করে দিলে নতুন চিপে যে ডাটা থাকবে, তাই দেখাবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে এ নিয়ে এটা রিপোর্ট দেবো৷ আর আমরাই ইভিএম মেশিন চাইবো৷ আমরা ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেখিয়ে দিতে পারবো কতভাবে কারচুপি করা যায়৷ আমরা এটা সাধারণ মানুষকেও দেখাতে চাই৷ আমরা আগে বলেছিলাম৷ কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাদের কাছে গিয়ে দেখাতে বলে৷ আমরা এটা প্রকাশ্যে করে দেখাতে চাই৷''
বিএনপি'র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীও বৃহস্পতিবার ইভিএম নিয়ে বিএনপি'র সেমিনারে কথা বলেন৷ তিনি শুক্রবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি তো বলেছি, এটা মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়ার একটা ব্যবস্থা৷ দেশের মানুষ এই জন্যই তো দেখেনি৷ এখানে পেপার ডকুমেন্ট নেই৷ মানুষ আগে এক হাতে ভোট দিত, এখন দু' হাতে ভোট দেবে৷ পৃথিবীর কোনো দেশে ইভিএম গ্রহণযোগ্য হয়নি৷''
রিয়াজুল ইসলাম জানান, ‘‘ ঐক্যফ্রন্টের নেতারা ইভিএম-এর বিরুদ্ধে মামলা করার কথাও বলেছেন৷ তাঁরা মামলা করতে পারেন৷''
এর জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার শুক্রবার বলেছেন, ‘‘যারা মামলা করবে, এটা তাদের ব্যাপার, আমার কিছু বলার নেই৷ আমরা ইভিএম সীমিত আকারে ব্যবহার করব৷ এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই৷''
আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিএনপি ইভিএম-এর মাধ্যমে যে তিন স্তরের কারচুপির কথা বলেছে, সেটা তাদের ব্যাপার৷ তারাই সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পরবে৷ ইভিএম-এ ভোটের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের৷ আমাদের দলের অবস্থান হলো, বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা ইভিএম কেন ব্যবহার করব না?''
নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত ৩৫০টি ইভিএম কিনেছে৷ প্রায় দুই লাখ টাকা মূল্যে একেকটি ইভিএম মেশিন কিনতে কমিশনকে মোট সাত কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে৷ আর ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেড় লাখ ইভিএম কিনতে তিন হাজার ৮২৯ কোটি সাত লাখ টাকার প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন৷