নির্বিচারে ইলিশ শিকার
২ আগস্ট ২০১৭সাময়িক লাভের খোঁজে কম দামের খোকা ইলিশের দিকে ঝুঁকেছেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা৷ এপার বাংলার মৎস্যজীবীদের জালে যা ইলিশ পড়ে, তার ৫০ ভাগের বেশিই ছোট মাপের৷ ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রুলস্ ১৯৮৫'-এর বিধি অনুযায়ী, ২৩ সেন্টিমিটারের কম দৈর্ঘ্যের ইলিশ মাছ ধরা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ৷ ধরলে সেই জেলের জেলও হতে পারে৷ শুধু তাই নয়, ইলিশ মাছ ধরার জন্য ৯০ মিলিমিটার কম ফাঁসের জালও ব্যবহার করা যাবে না৷ জালের ফাঁক বড় হলে তার ভিতর দিয়ে ছোট ইলিশ গলে যাবে, ধরা পড়বে না৷ এ সব নিয়ম সত্ত্বেও বাজারে খোকা ইলিশের অঢেল জোগান৷ ৫০০ গ্রামের নীচে তো বটেই, ১৫০-২০০ গ্রামের ইলিশও হাজির৷ খয়রা মাছ বলেও বিকোচ্ছে খোকারা৷
ইলিশকে ঘিরে যে উদ্বেগ ও প্রশ্ন, তা নিয়ে ডয়চে ভেলে হাজির হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎসবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শিবকিঙ্কর দাসের কাছে৷ ইলিশ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণারত অধ্যাপকের বক্তব্য, ছোট ইলিশে বাজার ছেয়ে যাওয়ার পিছনে দু'টো বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ একটি হলো আর্থ-সামাজিক৷ দ্বিতীয়টি অনেকাংশে সচেতনতামূলক৷ আর্থসামাজিক দিকটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অধ্যাপক বলেন, ‘‘যাঁরা মাছ ধরতে সমুদ্রে যান, তাঁদের লক্ষ্য থাকে দিনের শেষে কিছু উপার্জন করা৷ এই ইলিশের মরশুমের জন্য তাঁরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন৷ উপার্জনের উদ্দেশ্যেই বেআইনি জেনেও ছোট ছিদ্রের জাল দিয়ে মৎসজীবীরা মাছ ধরছেন৷ আর সেগুলো বাজরেও আসছে৷’’
তাই ‘‘বাজারে যদি ছোট ইলিশ আসে, তাহলে ক্রেতাদের তা বয়কট করতে হবে৷’’ এমনই মত অধ্যাপক দাসের৷ সচেতনতা প্রসারে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘উভয়পক্ষকেই ভাবতে হবে ভবিষ্যতের কথা৷ মৎসজীবীদের মাথায় রাখতে হবে যে, এভাবে খোকা ইলিশ ধরতে থাকলে ভবিষ্যতে জালে আর ইলিশ পড়বেই না৷ যাঁরা সেই মাছ বিক্রি করছেন, তাঁদের বুঝতে হবে যে, ছোট ইলিশ বেচলে তিনি ভবিষ্যতে বড় মাছ বেচে আরও বড় মুনাফা অর্জনের সুযোগ হাতছাড়া করবেন৷ আর আমরা যাঁরা ক্রেতা, তাঁরা যদি ছোট ইলিশ কিনি, তাহলে আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে৷ এগুলো ভেবে ছোট ইলিশ মাছ ধরা, বিক্রি করা এবং খাওয়া বয়কট করতে হবে৷ এর জন্য প্রয়োজন গণ-আন্দোলনের৷’’
খোকা ইলিশের রাজ্যপাট কতটা, তা সরেজমিনে দেখতে একাধিক বাজারে পৌঁছে গিয়েছিল ডয়চে ভেলে৷ ৫০০ গ্রামের কম ওজনের ইলিশ ধরা, বিক্রি ও কেনা বেআইনি৷ একটি বাজারে ৫০০ গ্রামের বেশি ওজনের ইলিশ দেখাই গেল না৷ এমনকি এক বিক্রেতা নিজে ওজন করে দেখালেন, তিনি যে মাছ বিক্রি করছেন, তার ওজন মেরেকেটে ৪০০ গ্রামও হবে না৷ বিভিন্ন বাজারে একই ছবি৷ এর ফলে কি ইলিশ সত্যিই বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে? অধ্যাপক দাসের কথায়, ‘‘ইলিশ সত্যিই কমছে৷ আজ থেকে ১০ বছর আগে যে পরিমাণ ইলিশ বাজারে আসত, এখন কি তা আর আসে? গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে ফারাকটা বুঝতে পারবেন৷ ইলিশ বড় না হলে তা প্রজননক্ষম হয়ে ওঠে না৷ ছোট অবস্থায় তা জল থেকে তুলে ফেললে ইলিশের সংখ্যা বাড়বে কী করে? এছাড়া দূষণও প্রভাব ফেলছে প্রজননে৷ থাবা পড়েছে স্বাদ-গন্ধেও৷ শিবকিঙ্করবাবুর বক্তব্য, ইলিশ যে জলজ উদ্ভিদ খায়, জলে দূষণের জেরে তাতে জৈবিক পরিবর্তন হচ্ছে৷ এর প্রভাব পড়ছে ইলিশের স্বাদেও৷
ইলিশের প্রশ্নে প্রতিবেশী বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক জায়গায় আছে বলে মনে করেন অধ্যাপক দাস৷ তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশের ইলিশের জোগান আমাদের তুলনায় বেশি৷ ফারাক্কায় বাঁধ দেওয়ার ফলে পদ্মা যতটা ইলিশ পায়, আমরা পাই না৷ বাংলাদেশের মাথাপিছু রোজগার আমাদের থেকে কম৷ এর ফলে সেখানে চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য এপার বাংলার তুলনায় বেশি৷ তাই সে দেশে ক্রেতাদের সাধ্য অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত বড় মাপের ইলিশের জোগান থাকে৷ তাছাড়া বাংলাদেশে ইলিশ ধরার আইন কঠোরভাবে কার্যকর করা হয়৷’’
বাংলার রসনা সাহিত্যে যাঁর লেখা সমাদৃত, সেই সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তীও এ ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রশংসা করছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে মাস দুই-তিনেক ইলিশ না ধরার যে আইন রয়েছে, সেটা ওরা কড়াভাবে বলবৎ করে এবং তার সুফল পায়৷ আমাদের দেশে আইন থাকলেও, সেটা কার্যকর হয় না৷ অথচ সরকার চেষ্টা করলেই পারে৷ কড়া নজরদারির ফলে কচ্ছপ তো এখন আর বাজারে পাওয়া যায় না৷ তাহলে ইলিশের ক্ষেত্রে নজরদারি নয় কেন?’’
পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবশ্য খোকার বাড়বাড়ন্তের অভিযোগ মানতে চাইছে না৷ রাজ্যের মৎসমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেন, খোকা ইলিশে যে বাজার ছেয়ে গেছে, এটা ঠিক নয়৷ পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে৷ খোকা ইলিশের বিপণনে যাতে আরও লাগাম টানা যায়, তার চেষ্টা চলছে৷
দীর্ঘদিন আকাশবাণী কলকাতার বিজ্ঞান বিভাগের দায়িত্বে থাকা স্বপ্নময় চক্রবর্তী অবশ্য মন্ত্রীর কথায় এতটা ভরসা পাচ্ছেন না৷ ইলিশের বিলুপ্তির আশঙ্কা তাঁর মনেও৷ বললেন, ‘‘যেখানে পরিযায়ী পাখিদের খুব বেশি হারে শিকার করা হয়, সেখানে তাদের আনাগোনা ক্রমশ কমতে থাকে৷ ইলিশের ক্ষেত্রেও সেটা হতে পারে৷ হয়ত ইলিশের এমন জিনগত পরিবর্তন হলো, তার ফলে আমাদের জলসীমায় ইলিশের সংখ্যা কমে গেল৷’’
অধ্যাপক দাসের মতো স্বপ্নময়বাবু জনতার সচেতনতায় ভরসা রাখতে পারছেন না৷ তাঁর সরস মন্তব্য, ‘‘দু'শ টাকা কেজিতে যদি ঝোলে ইলিশের গন্ধ পাওয়া যায়, তাহলে সেটা খোকা না ধেড়ে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার স্বাদ পাবে কিনা, পরের বছর ইলিশ পাবো কিনা — এ সব আর কে ভাবতে চায় বলুন?