জতুগৃহ দিল্লি
৯ ডিসেম্বর ২০১৯রীতিমতো ছোট গলি। দিনের বেলা কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেলে চার-পাঁচজনের বেশি লোক পাশাপাশি চলতে পারবে না। মাথার ওপর, পাশে মাকড়শার জালের মতো সরু, মোটা তার। হাই টেনশন লাইনের পাশাপাশি কেবল টিভি, টেলিফোন থেকে শুরু করে কত যে লাইন গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কোনও তার ৪৪০ ভোল্টের। কোনওটা ২২০ ভোল্টের। কোনও তার এমন বিপজ্জনকভাবে ঝুলে রয়েছে, দেখলেই ভয় লাগে। অবস্থা এমনই যে, বিদ্যুৎ বিভাগ বা পুরসভাও জানে না কোন তার কী কাজে লাগে। কোনটা আইনি, কোনটা বেআইনি তা উদ্ধার করা অসম্ভব। দুপাশের বাড়িগুলির মধ্যে তিলমাত্র ফাঁক নেই। একটার গায়ে আরেকটা বাড়ি। জায়গাটার নাম ফিল্মিস্তান আনাজ মন্ডি। এরই মধ্যে একটি ছশো গজের বাড়ি, যেখানে ব্যাগ তৈরির কারখানায় আগুন লেগে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এমন গলি, এমন জায়গা, এমন পরিবেশ যে দুর্ঘটনা না ঘটাই আশ্চর্যের।
নব ভারত টাইমসের মেট্রো এডিটর গুলশন ক্ষত্রি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''এই ধরনের আগুন লাগলে কিছুদিন হইচই হয়। সরকার, পুরসভা একটু সক্রিয় হয়। তারপর যে কে সেই। দিল্লির মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী আবাসিক এলাকার মধ্যে কোনও কারখানা থাকতে পারে না। এই ধরনের কারখানা যেখানে আছে, তা নারেলার মতো শিল্পতালুকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা।'' আসলে খাতায় কলমে সবই থাকে, ভয়াবহ ঘটনা ঘটলে কিঞ্চিত নড়াচড়া হয়। তারপর সবকিছুই যে কে সেই চলতে থাকে।
যে গলিতে ভয়বাহ আগুন লেগেছে, সেটা নামেই আবাসিক এলাকা। আদতে একের পর এক বাড়ি জুড়ে শুধু কারখানা। পুড়ে যাওয়া কারখানাটি ছিল সবমিলিয়ে পাঁচ তলা। একটু দূরেই আটতলা বাড়িও রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে ডয়চে ভেলেকে রফিক জানালেন, ''সব মিলিয়ে এই গলিতেই দেড়শোর মতো কারখানা আছে। নানা ধরনের জিনিস সেখানে তৈরি হয়। কেউই ফায়ার লাইসেন্স নেয়নি।'' রফিক নিজেও এরকমই একটি কারখানায় কাজ করেন। দুটো শিফটে কাজ করলে আড়াইশো টাকা পাওয়া যায়। একে তো আবাসিক এলাকায় কারখানা, তার ওপর ফায়ার লাইসেন্স নেওয়া হয়নি। ফলে সম্পূর্ণ বেআইনি। তার ওপর আরেকটি বেআইনি বিষয়ও আছে। সেটা হল, জমা দেওয়া পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে বাড়িতে যথেচ্ছ নির্মাণ, এমনকী এক বা একাধিক তলা যোগ করে নেওয়ার গল্প।
সে কারণেই দিল্লির অত্যন্ত ব্যস্ত ও ঘিঞ্জি বাজারগুলো পুরোপুরি জতুগৃহ। রবিবার ভোর রাতে যে বাড়িতে আগুন লাগে, শনিবার তার কাছেই একটি বাড়িতে আগুন লেগেছিল। দমকল গিয়ে তা দ্রুত নিভিয়ে দেয়। দিল্লির সদরবাজারে এর আগেও আগুন লেগেছে।
কলকাতার অবস্থাও আলাদা কিছু নয়। সেখানে গত কয়েক বছরে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। বড় বাজারে নন্দরাম মার্কেট, পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন হাউসের পর কয়েক মাস আগে বাগড়ি মার্কেটে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় প্রচুর ওষুধ। সেখানেও পুরসভা ও সরকারের তদন্তের পর দেখা গিয়েছে, কারণ একই। ফায়ার লাইসেন্স না নেওয়া, অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা না থাকা ও যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা ইলেকট্রিক তার। বিভিন্ন সময় টাস্ক ফোর্স তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। ফলে দিল্লি থেকে কলকাতা, সর্বত্র অসুখ একই। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সচেতন না হলে এ অসুখ সারবে না।