ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত মূল সত্য
২ এপ্রিল ২০২০যে কোনও ঘটনায় সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির প্রবণতা এখন ভারতীয় সমাজে একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতির অঙ্গুলিহেলনে। গত কয়েক বছরের দুঃখজনক সত্য হল, ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান চালকরা বিভাজনের তাসকেই সর্বত্র প্রয়োগ করছে। ফলে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতেও সেই বিভাজনের রাজনীতিই সামনে চলে আসছে। করোনা সংক্রমণের জন্য আঙুল তোলা হচ্ছে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের দিকে। শুধু তা-ই নয়, উঠে আসছে সন্ত্রাসবাদের প্রসঙ্গও। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যখন সকলের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কথা, তখন এ ধরনের বিভাজন শুধু আশঙ্কারই নয়, যথেষ্ট চিন্তার।
ঘটনার সূত্রপাত তাবলিগ-ই-জামাতের একটি জমায়েতকে কেন্দ্র করে। গত ১৩ থেকে ১৫ মার্চ দিল্লির নিজামুদ্দিন অঞ্চলে তাবলিগের মার্কাজে একটি ধর্মীয় জমায়েতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যেখানে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় চার হাজার প্রচারক। সারা পৃথিবী থেকেই প্রচারকেরা সেই জমায়েতে অংশ নিতে এসেছিলেন। লকডাউনের জন্য যাঁদের অনেকেই এখনও রয়ে গিয়েছেন এ দেশে। দিনকয়েক আগে তেলেঙ্গানায় ছয় জনের করোনায় মৃত্যু হওয়ার পরে জানা যায়, তাঁরা সকলেই নিজামুদ্দিনে ওই জমায়েতে যোগ দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, খবর মেলে, ওই জমায়েত থেকে ফিরে যাওয়ার পরে কাশ্মীরেও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এরপরেই নড়েচড়ে বসে সরকার। পরীক্ষা করে দেখা যায়, ওই জমায়েতে যোগ দেওয়া বহু মানুষের শরীরেই করোনার জীবাণু। সমস্যা হল, সভার শেষে বহু প্রচারক দিল্লি ছেড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। ফলে তাঁদের মাধ্যমে ভাইরাস কমিউনিটি বা গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বহু রাজ্য থেকেই তেমন খবর মিলছে।
প্রথমেই বলে রাখা দরকার, ১৩ থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে তাবলিগ যে বিপুল জমায়েতের আয়োজন করেছিল, তা কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তারা যা করেছে, তা কেবল দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মার্চের গোড়াতেই বোঝা গিয়েছিল ভারতে করোনার সংক্রমণ ক্রমশ ছড়ানোর সম্ভবনা তৈরি হচ্ছে। যে কারণে হোলির এবং দোলের উৎসব বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠান এত বছরের বসন্ত উৎসব বন্ধ রেখেছিল। দিল্লি সরকার এক সঙ্গে ৫০ জনের বেশি জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। যদিও তখন ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অনুষ্ঠান বাতিলের নির্দেশ জারি হয়নি। ১৬ মার্চ সে ঘোষণা আনুষ্ঠানিক ভাবে করা হয়। কিন্তু ৫০ জনের বেশি সমাবেশ না করার নির্দেশিকা আগেই জারি হয়েছিল। মার্চের গোড়াতেই বোঝা যাচ্ছিল দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সপ্তাহ থেকে করোনার প্রকোপ বাড়বে। ফলে প্রতিটি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় সংগঠনের এ ধরনের অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকার একটি দায় থেকে যায়। তাবলিগ তা পালন না করে অবশ্যই অন্যায় করেছে। তার ফল আজ গোটা দেশ ভুগছে। সমস্যা রয়েছে আরও। ১৫ তারিখ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কেন মার্কাজে আরও এক সপ্তাহ রেখে দেওয়া হল প্রচারকদের এক বড় অংশকে। যার মধ্যে বিদেশি অভ্যাগতরাও ছিলেন? কেন অনুষ্ঠানের পরেই অনুষ্ঠানস্থল ফাঁকা করে দেওয়া হল না? তাবলিগ বলছে, লকডাউনের ফলে বহু লোক আটকে পড়েছেন। কিন্তু লকডাউন তো আরও এক সপ্তাহ বাদে শুরু হয়েছে! মাঝের এত গুলো দিনে কেন সরানো গেল না অংশগ্রহণকারীদের? এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর এখনও মেলেনি। দিল্লি পুলিশের দাবি, তারাও তাবলিগের কর্মকর্তাদের অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বলেছিল। দাবি যদি সত্য হয়, তা হলে কেন তা শুনলেন না কর্মকর্তারা?
কিন্তু এর বাইরেও আরও কিছু প্রশ্ন থাকে। পর পর কিছু ঘটনা সাজিয়ে দেওয়া যাক। তাবলিগের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল ১৩ মার্চ। শেষ হয়েছে ১৫ মার্চ। ১৩ মার্চ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছিল, করোনা ভাইরাস এ দেশে 'স্বাস্থ্য ইমার্জেন্সি' নয়। ১৬ মার্চ একটি হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন, যাদের সঙ্গে বিজেপির নিবিড় যোগাযোগ, রাজধানী দিল্লিতে গোমূত্রের পার্টি করে। কয়েকশ লোক সেখানে হাজির হন। ওই ১৬ মার্চেই দিল্লি সরকার সমস্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু ১৯ মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতে খোলা ছিল তিরুপতি মন্দির। প্রতিদিন অন্তত ৪০ হাজার দর্শনার্থী গিয়েছেন সেখানে। লাইনে দাঁড়িয়ে পুজো দিয়েছেন। লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরেও খোলা ছিল কাশ্মীরের বৈষ্ণদেবী মন্দির। সেখানে আটকে পড়েছেন ৫০০ পূণ্যার্থী। এখানেই শেষ নয়, মার্চের গোড়ায় ইটালি এবং জার্মানি ঘুরে দেশে ফিরেছিলেন এক শিখ ধর্মগুরু। বিমানবন্দরে তাঁর কোনও রকম পরীক্ষা হয়নি। পাঞ্জাবে গিয়ে ডজনখানেক গ্রামে ঘুরে তিনি ধর্মপ্রচার করেছেন। দিন দশেক আগে তাঁর মৃত্যুর পরে জানা যায়, সেই গুরুও করোনা আক্রান্ত ছিলেন। ১৮ মার্চ পাঞ্জাবের অসংখ্য গ্রাম সিল করে দেয় প্রশাসন। আশঙ্কা, ওই গুরুর সংস্পর্শে এসে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন। এখনও পর্যন্ত ওই সমস্ত গ্রামের অন্তত কয়েকশ ব্যক্তির শরীরে করোনার জীবাণু মিলেছে।
এত কিছুর মধ্যেও ২৩ মার্চ পর্যন্ত সংসদে অধিবেশন চলেছে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সেই সংসদ উত্তাল হয়েছে মধ্যপ্রদেশে সরকার বদল নিয়ে। বিজেপি মধ্যপ্রদেশের বিদ্রোহী বিধায়কদের একসঙ্গে নিয়ে গিয়েছে গোপন ডেরায়। কংগ্রেসও নিজেদের বিধায়কদের নিয়ে একই কাজ করেছে। ২৩ তারিখ মধ্যপ্রদেশের বিধানসভায় নতুন সরকার তৈরি করেছে বিজেপি। সেখানে এক জায়গায় উপস্থিতি ছিলেন কয়েকশ বিধায়ক। শুধু তাই নয়, সদ্য দল বদলানো মধ্যপ্রদেশের নেতা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে এই পরিস্থিতির মধ্যেই ভোপালে বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হয়। রাস্তার দুই ধারে হাজির হন কয়েক হাজার বিজেপি সমর্থক। জ্যোতিরাদিত্যকে কাঁধেও তুলে নেন বহু উৎসাহী কর্মী। হ্যাঁ, এই সামাজিক দূরত্বের আবহেই। আর সব চেয়ে আশ্চর্যের ঘটনাটি তো ঘটিয়েছেন খোদ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। নরেন্দ্র মোদী লকডাউনের ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অযোধ্যায় রামলালা যাত্রা করেন সপার্ষদ যোগী। এ সব অন্যায় নয়? অপরাধ নয়?
লম্বা এই তালিকা আসলে একটি বিষয়ই প্রমাণ করে, নির্দেশ যাই থাক, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীগুলি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তা ভঙ্গ করে গিয়েছে। মৃত্যু হয়েছে, তাই তাবলিগের এবং শিখ ধর্মগুরুর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আলোচনায় উঠে এসেছে। বাকি ঘটনাগুলি ধামা চাপা পড়ে গিয়েছে। প্রশ্ন হল, ধামা চাপা পড়েছে, না কি ধামা চাপা দেওয়া হয়েছে? এখানেই চলে আসে রাজনীতির প্রসঙ্গ।
তাবলিগের ঘটনা প্রচার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কোনও কোনও মহল থেকে একটি সম্প্রদায়ের দিকে আঙুল তোলা শুরু হয়েছে। প্রচারের কৌশলে বোঝানোর চেষ্টা চলছে, ভারতে কেবল একটি সম্প্রদায়ই করোনা ছড়ানোর জন্য দায়ী। বাকিরা ধোয়া তুলসি পাতা। গুজরাটে রীতিমতো লিফলেট বিলি করে প্রচার করা হচ্ছে, নিজামুদ্দিনের ঘটনা আসলে একটি সংগঠিত 'সন্ত্রাসবাদী' চক্রান্ত।
গল্পের গরু মগ ডালেও চড়তে পারে। সমস্যা হল, ইদানীং ভারতীয় সমাজ, গণমাধ্যম এবং রাজনীতি ওই মগডালের গরুকে নিয়েই রাতদিন বিতর্ক করে যায়। তারা প্রশ্ন করে না, কী ভাবে ওই শিখ ধর্মগুরু বিমানবন্দর থেকে কোনও পরীক্ষা ছাড়াই বেরিয়ে পড়েন? তখন কোথায় ছিল প্রশাসন? কী ভাবে তাবলিগের জমায়েতে আসতে পারলেন বিদেশি অভ্যাগতরা? কেন তাঁদের বিমানবন্দরেই আটকে দেওয়া হল না? কী ভাবে ঘটল তালিকায় দেওয়া আর সব ঘটনা? কোথায় ছিল পুলিশ, প্রশাসন, সরকার? কোথায় ছিল আইনের শাসন?
এ সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না। কারণ এ সব উত্তর দিতে গেলে রাজনীতির পরিকল্পিত ছকটি ভেঙে যায়। সমাজের পরিকল্পিত বিভাজনটি ভেস্তে যায়। ইসলামোফোবিয়ার সরলরৈখিক উদ্দেশ্যটি বানচাল হয়ে যায়।