ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ মধ্য ফেব্রুয়ারিতে?
২৮ জানুয়ারি ২০১৯আত্মসমর্পণের বিষয়টি দেখছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ৷ জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মধ্য ফেব্রুয়ারিতে আত্মসমর্পণ করতে পারেন তারা৷ অনেকেই আত্মসমর্পণের জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন৷ যারা যোগাযোগ করছেন, তাদের মধ্যে শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রয়েছেন৷'' তবে ঠিক কতজন আত্মসমর্পণ করতে পারেন সে সংখ্যার ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলেননি৷ আর এরইমধ্যে আটক বা পুলিশ হেফাজাতে ৭০ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে নেয়ার খবর তিনি স্বীকার করেননি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করছেন৷ তারা আমাদের নজরদারিতেও আছেন৷ কিন্তু আমাদের হেফাজতে কেউ নাই৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘এই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় আমরা একটি টিভি চ্যানেল ও একটি পত্রিকার সহায়তা নিচ্ছি৷ ঠিক কত জন আত্মসমর্পণ করবেন, তারাই বলতে পারবেন৷ ইয়াবা ব্যবসায়ীরা তাদের সঙ্গেই প্রথমে যোগাযোগ করছেন৷ আত্মসমর্পণের তারিখ চূড়ান্ত হলে তখন বোঝা যাবে ঠিক কতজন আত্মসমর্পণ করবে৷''
টেকনাফের মো. ওসমান ডয়চে ভেলেকে জানান, তাঁর ছেলে জোবাইর হোসেন ১২ দিন আগে কক্সবাজারে আত্মসর্পণ করেছে৷ সে এখন সেখানেই পুলিশ হেফাজাতে আছে৷ আত্মসমর্পণের পর তিনি তাঁর ছেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু দেখা করতে পারেননি৷ তাঁর দাবি, তাঁর ছেলে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত না৷ তবে ইয়াবার মামলা আছে ছেলের বিরুদ্ধে৷ তিনি নিজে মাছের ব্যবসা করেন৷ তাঁর ছেলেও তাই করে৷ তাহলে ছেলে আত্মসর্পণ করেছে কেন জানাতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘মামলা আছে৷ পুলিশ ধরতে পারলে তো ক্রস ফায়ারে দেবে৷ তাই আত্মসমর্পণ করেছে৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আরো অনেকে আত্মসমর্পণ করেছে৷ তারাও ক্রসফায়ার থেকে বাঁচতেই আত্মসমর্পণ করেছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘কবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে এবং আত্মসমর্পণের পর কী হবে আমরা কিছুই জানি না৷ আমাদের কিছুই জানানো হচ্ছে না৷''
তবে টেকনাফের সাংবাদিক আব্দুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এ পর্যন্ত ৭০ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশের হেফাজতে আছেন৷ তারা আত্মসমর্পণ করতে চেয়ে স্বেচ্ছায় পুলিশ হেফাজতে গেছেন৷ তাদের কক্সবাজার পুলিশ লাইনের সেফ হোমে রাখা হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত মোট ৮০ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করতে পারেন৷''
টেকনাফের সাংবাদিক আব্দুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে ৭০ জনের মতো সেফ হোমে আছে৷ তাদের মধ্যে ইয়াবা ব্যবসায় আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির তিন ভাইসহ ১০ জন আত্মীয়-স্বজন আছেন৷ জনপ্রতিনিধি আছেন৷ উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলে আছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘বদি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানোর পর তারা পর্যায়ক্রমে বদির সহয়াতায় পুলিশের সেফ হোমে চলে যায়৷''
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ২৫২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা করেছে৷ তাদেরই একটি অংশ পুলিশের সেফ হোমে আছেন৷ কক্সবাজারের পুলিশ সুপার জানান, ‘‘একদিন আমাদের কাছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা ছিল, যাদের সবাই চিনতো৷ সব বাহিনীই তাদের বিরুদ্ধে তাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে৷ কিন্তু এখন আমরা আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে আরো নতুন ইয়াবা ব্যবসায়ী ও গডফাদারদের নাম জানতে পারছি, যাদের কথা কেউ জানতো না, যারা আড়ালেই ছিল৷ আমরা মনে করি, তাদের চিহ্নিত করতে পারা আমাদের অগ্রগতি৷''
এদিকে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করছেন বেসরকারি টেলিভিন চ্যানেল২৪-এর চট্টগ্রাম ব্যুরোর সাংবাদিক আকরাম হোসেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত বছরের ২০ অক্টোবর আমার মধ্যস্থতায় কক্সবাজারের মহেশখালীতে ৫টি জলদস্যু বাহিনীর ৩৭ জন সদস্য অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে৷ এরপর আমার দায়িত্বের জায়গা থেকেই তাদের আমি কারাগারে দেখতে যেতাম৷ সেখানে আমার সঙ্গে কারাগারে আটক ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয়৷
তারা তখন আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া জানতে চায় এবং কারাগারের বাইরে তাদের আত্মীয়-স্বজন যারা ইয়াবা ব্যবসা করে, তাদের আত্মসর্মণের আগ্রহ দেখায়৷ আমি বিষয়টি নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলি৷ এরপর কারাগারে আটক ইয়াবা ব্যবসায়ীরা বাইরে তাদের যেসব আত্মীয়-স্বজন ইয়াবা ব্যবসা করে, তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলে৷ তারপরই আমি মধ্যস্থতা শুরু করি৷''
তিনি বলেন, ‘‘এ পর্যন্ত যারা আত্মসর্পণের জন্য যোগাযোগ করেছেন, তারা সবাই আমার মাধ্যমেই যোগাযোগ করেছেন৷ আর আমার সঙ্গে প্রায় দেড় থেকে দু'শ' ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণে ইচ্ছুক বলে যোগাযোগ করেছেন৷''
এখন পর্যন্ত কতজন সেফ হোমে আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের সেফ হোমের বিষযটি আমার জানা নেই৷ তবে যারা আত্মসর্পণে ইচ্ছুক তারা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে নিরাপদ কোনো জায়গায় অবস্থান করছে বলে আমি জানি৷''
আরেকটি সূত্র জানায়, ‘‘সোমবার বিকেল পর্যন্ত ৯০ জন সেফ হোমে আশ্রয় নিয়েছে৷ রাত নাগাদ তাদের সংখ্যা ১০০ জন হয়ে যাবে৷'' ওই সূত্র মতে, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিগনাল পেলেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে কক্সবাজার পুলিশ প্রশাসন৷ তাদের সব প্রস্তুতি আছে৷''
আত্মসমর্পণ এবং পরবর্তী প্রক্রিয়া কী হবে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘সেটা এখনই প্রকাশ করা যাচ্ছে না৷ তবে যাদের বিরুদ্ধে আগে মামলা আছে, সেসব মামলা আইনগতভাবে চলবে৷ আত্মসমর্পণের পর তারা যদি আবার ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়ে, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ তবে আমি মনে করি ইয়াবা ব্যবসা যেভাবে ছড়িয়েছে, অনেকেই এটাকে স্বাভাবিক ব্যবসা হিসেবে দেখে৷ তাই আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনও দরকার৷''
তাদের পূনর্বাসন করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আত্মসমর্পণের পর তারা যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান এই ইয়াবা ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে, তাহলে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে সে সিদ্ধান্ত সরকার এখনো আমাদের জানায়নি৷''
এদিকে ইয়াবা ব্যবসায় আলোচিত আব্দুর রহমান বদি কিন্তু প্রকাশ্যেই আছেন৷ জানা গেছে, তিনি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে থাকতে পারেন৷ সমালেচনার কারণে আওয়ামী লীগ একাদশ সংসদ নির্বাচনে বদিকে মনোনয়ন দেয়নি৷ মনোণয়ন দিয়েছে তার স্ত্রী শাহীনা আক্তার চৌধুরীকে৷ তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন৷ তিনি এরইমধ্যে সংবাদ মাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, ‘‘আমার স্বামী (বদি) ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত বলে কোনো প্রমাণ নেই৷''