ঈদ উৎসবও যেন বিপর্যস্ত!
৯ জুলাই ২০২২নাজমুল হক ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন৷ এবার কোরবানির ঈদে পরিবার নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ গত দুই বছর ঈদে করোনার কারণে যেতে পারেননি৷ তাই এবার গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছেটা ছিলো প্রবল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি৷ ঢাকাতেই থেকে গিয়েছেন৷ তিনি জানান, আর্থিক সংকটই প্রধান কারণ৷ গ্রামে গেলে আসা যাওয়ার খরচসহ বাড়তি আরো অনেক খরচ আছে৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে হাতে বাড়তি কোনো টাকা তো নেইই, উল্টে ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে৷ তিনিঢাকাতে গরুর একভাগ কোরবানিদিচ্ছেন তাও বাজেট অনেক কাটছাঁট করে৷ আর ঢাকায় তেমন লোডশেডিং না হলেও গ্রামের অবস্থা খুবই খারাপ বলে জানান তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘ আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধব যারা আছেন তাদের প্রায় সবারই একই অবস্থা৷ কেউ কেউ আর্থিক সংকটের কারণে কোরবানির চিন্তাই বাদ দিয়েছেন৷ আসলে মধ্যবিত্ত আছে চরম সংকটে৷ সে কাউকে বলতেও পারেনা৷ সইতেও পারেনা৷''
বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধি গত আট বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোই এই হিসাব দিয়েছে৷ তারা বলছে এখন মূল্যবৃদ্ধি গড়ে শতকরা ৭.৪২ ভাগ৷ আর এটা শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণেই এই মূল্যবৃদ্ধি৷ তবে বাস্তবে এটা আরো বেশি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা৷ কিন্তু এই সময়ে সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি৷
করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ তার উপর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভোজ্য তেল এবং জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রভাবও পড়েছে এখানে৷ কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)-এর সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘‘বিশ্ববাজারের চেয়ে এখানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার হার বেশি৷ কারণ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দেয় কোনো অজুহাত পেলেই৷ সরকারেরও কোনো মনিটরিং নেই৷''
ইএনডিপির কান্ট্রি ইকনোমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘এখন বেরো ধানের ভরা মৌসুম৷ বন্যার আগেই আমন উঠে গেছে৷ তাহলে তো চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই৷ কিন্তু তারপরও চালের দাম বাড়ছে৷''
দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়িত হওয়ার কথা কিছুদিন আগে বলা হলেও এখন লোডশেডিং শুরু হয়েছে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজির দাম বেড়ে যাওয়ায় সব বিদ্যুৎ কারখানা চলানো যাচ্ছেনা বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে৷ আর দেশেও গ্যাসের ঘাটতি চলছে৷ এখন প্রতিদিন কমপক্ষে দুই হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে৷
সরকার বলছে, এই পরিস্থিতি কমপক্ষে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে৷ এই ঈদেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই৷ সারা দেশে এখন বিদ্যুতের রেশনিং চলছে৷ গড়ে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে৷ দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ব্যবসায়ি মিজানুর রহমান মিজু বলেন, ‘‘ শহরে কী অবস্থা জানিনা তবে আমাদের গ্রামের দিকে এখন দিনে চার থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকেনা৷''
ব্র্যাকের গত বছরের হিসেবে বাংলাদেশে করোনায় অতিরিক্ত নতুন করে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন৷ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে চলতি বছরে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন আরো ২১ লাখ মানুষ৷ এই জরিপও ব্র্যাকের৷ দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে৷ এখন ৭০ ভাগ মানুষকেই তাদের আয়ের বড় অংশই খাদ্য কিনতে ব্যয় করতে হয়৷
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ অন্যান্য জেলার বন্যার পানি নামলেও তাদের আশ্রয় নষ্ট হয়েছে৷ সম্পদ ও ফসল হারিয়েছেন তারা৷ সিলেটের সাংবাদিক ওয়াসে খসরু জানান, ‘‘ওই অঞ্চলের অনেকেরই এবার ঈদ হবে আশ্রয় কেন্দ্রে৷ আর আগে যারা তিন-চারটি গরু কোরবানি দিতেন তারা একটি দিচ্ছেন৷ আর যারা ভাগে দিতেন তারা দিতে পারছেন না৷ গরুর হাটেও ক্রেতাদের তেমন ভিড় নেই৷ গরুও কম৷''
তবে তিনি জানান, দেশের অন্যান্য এলাকার বিত্তশালীরা কোরবানির গরু সিলেটের গরিব মানুষের জন্য পাঠাচ্ছেন৷ কিছু এনজিও সেখানে গরু কোরবানির ব্যবস্থা করছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাংস পাঠানো কঠিন৷ এখনো যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি৷
ক্যাব-এর এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘‘মানুষ এখন দারিদ্র্য আর দ্রব্যমূল্যের চাপে আছে৷ তার উপরে শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ সংকট৷ ঈদে যানবাহনের চিরাচরিত ভোগান্তি একটু কমেনি৷ ফলে ঈদের সেই আনন্দ আর আশা করা যায়না৷ আর সিলেট অঞ্চলের মানুষ তো চরম সংকটে আছেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘ মধ্যবিত্ত তার সাধ্যের মধ্যে ছোট গরু কোরবানি দিত৷ এবার সেইছোট গরুর দামও বেড়ে গেছে৷ কারণ আর্থিক সংকটের কারণে চোট গরুর চাহিদা বেড়েছে৷ তাই কেউ কেউ কোরবানি দিচ্ছেন না৷''
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘ এখন ঈদের খুশির চেয়ে মানুষের বড় প্রয়োজন খাদ্য৷ সরকার ওএমএস-এর মাধ্যমে যে পণ্য বিক্রি করছে তার পরিধি বাড়াতে হবে৷ আর এটা যাতে সবাই পায় তা নিশ্চিত করতে হবে৷ এর সঙ্গে সরকার যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী করেছে তাও বিস্তৃত করতে হবে৷'
তার কথায়, ‘‘গরিব মানুষ এই ঈদে কিছু পাবে৷ বিত্তশালীদের তো আর্থিক সমস্যা নেই৷কিন্তু মধ্যবিত্তকে কে দেখবে৷ সে লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে পারেনা৷ আর উচ্চমূল্যে কেনারও সক্ষমতা নেই৷ এই ঈদে তাদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি৷’’
ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবারও বেড়েছে৷ ঈদের আগের ছয়দিনে সাত হাজার কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছে৷
নাজনীন আহমেদ বলেন, তাতে রিজার্ভ হয়তো কিছুটা বাড়বে৷ আর প্রবাসীদের পরিবার পরিজন ঈদটা ভালোভাবে করতে পারবেন৷ কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে হয়না৷ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে৷ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে৷
মুসলমানদের কোরবানির ঈদ সক্ষমদের জন্য৷ এই সময়ে তারা কোরবানির মাংস গরিব এবং আত্মীয় স্বজনদের দেন৷ আর তারা টাকা পয়সা দানও করেন৷ কিন্তু আয় বর্ধক না হলে তাতে লাভ নেই বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ৷
তার কথায়, কোরবানিতে গরিব মানুষ যে মাংস পান তাও তারা সংরক্ষণ করতে পারেন না৷ কারণ তাদের তো আর ফ্রিজ নাই৷ ফলে তারা ওই মাংস কম দামে বিক্রি করে দেন৷ এতে লাভবান হয় হোটেল মালিকরা৷
সার্বিক বিবেচনায় দুই বছর করোনার পর এবার কোরবানির ঈদ যে খুশির বার্তা নিয়ে আসার কথা তা আসেনি৷ শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ তাই যদি সম্ভব হয় বন্যা দুর্গত এলাকায় গিয়ে পশু কোরবানি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ যাতে তারা কোরবানির মাংস খেতে পারেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি আমার গরু সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি৷ অন্যরাও করতে পারেন৷ আর যারা একাধিক পশু কোরবানি দেন তারা একটি দিয়ে বাকি টাকা গরিব মানুষকে দিতে পারেন৷ কোরবানি হলো ত্যাগের উৎসব৷ আমরা যদি সবাই ত্যাগের মনোভাব দেখাই তাহলেই সেটা হবে আনন্দের৷’’