ঈদে বৈষম্য কি আরো স্পষ্ট হয়?
১ মে ২০২২দুই বছর করোনা কাল কাটিয়ে এবার ঈদ হচ্ছে বিধিনিষেধ মুক্ত পরিবেশে৷ তাই শপিংমল থেকে ফুটপাত সবখানেই দেখা গেছে কেনাকাটার জন্য উপচে পড়া ভিড়৷ আর শহর ছেড়ে এবার গ্রামে মানুষের ঢল নেমেছে প্রিয় জনের সাথে ঈদ করার জন্য৷ কিন্তু আনন্দ, সম্প্রীতি আর বৈষম্য দূর করার ঈদ বাস্তবে কতটা পাওয়া যাবে? বৈষম্য আরো কি প্রকটভাবে দেখা দেবে?
ভোগের সক্ষমতার লড়াই
সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন, ঈদের আদর্শিক দিক যাই হোক না কেন, এখানে ভোগের বিষয় থাকে৷ আর ভোগের সক্ষমতা সবার সমান নয়৷ আয় বৈষম্য ব্যাপক৷ ঈদে উৎসবের নামে তা প্রকাশ হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘দান খয়রাতেও সেটা প্রকাশ পায়৷ এক শ্রেণি পূণ্যের আশায় দান করে৷ আরেক শ্রেণি সেটা নিতে লাইন ধরে৷ জাকাতের কাপড় দেয়ার নামে আমরা গরিব মানুষের লম্বা লাইন দেখি৷ সারা বছরের দারিদ্র্য যেন তখন নগ্নভাবে প্রকাশ পায়৷ ঈদে ফুটপাতের আর আধুনিক শপিংমলের পাশাপাশি কেনাকাটা পার্থক্যটা বুঝিয়ে দেয়৷''
তার কথা, ‘‘সমাজে ও রাষ্ট্রে বৈষম্য দূর করতে না পারলে আসলে কোনো আদর্শিক বুলি কাজে আসেনা৷''
অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ অবশ্য মনে করেন, ঈদের একটা অর্থনীতি আছে৷ এর ফলে মৌসুমী কর্মসংস্থান বাড়ে৷ উৎসবে বেচাকেনা বাড়লে তার একটি ইতিবাচক দিক আছে৷ যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের হাতে কমবেশি অর্থ আসে৷ অর্থনীতি সচল হয়৷ এছাড়া ধর্মীয় কারণে বিত্তবানরা দরিদ্রদের দান করেন৷ ফলে অন্যান্য সময়ের চেয়ে এই সময়ে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়৷ তবে তাতে সার্বিক বৈষম্য কমেনা বলে মনে করেন তিনি৷ তার কথা, ‘‘সারা বছর আমরা যা দেখিনা তা ঈদে দেখা যায়৷ কেউ অনেক খরচ করেন৷ কেউ কিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন৷ কেউ অনেক দামি জামা জুতা কেনেন৷ উপহার দেন৷ কেউ পারেন না৷ তাই স্বাভাবিক কারণেই এই সময়ে বৈষম্যটা দেখা যায় বেশি৷ আর এটা নিয়ে মধ্যবিত্ত থাকে সবচেয়ে বেশি সংকটে৷ সে চাইতেও পারেনা, দিতেও পারেনা৷''
তবে তার মতে, যাকাত ব্যবস্থাপনাটা যদি আরো সুশৃঙ্খল করা যেত তাহলে হয়তো এই বৈষম্যের প্রকাশ একটু কম হতো৷
আয় বৈষম্য
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএসের সর্বশেষ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬.৭ শতাংশ মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে৷ বিপরীতে ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মোট আয়ের ১৭.১ শতাংশ৷ অসাম্য সূচকের হিসেবে, বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ৪৪ শতাংশ আছে ১০ শতাংশ মানুষের হাতে৷ প্রতিবছর দেশে এখন নতুন করে কোটিপতি হচ্ছেন পাঁচ হাজার৷ এইসব তথ্যে আয় বৈষম্য যে বাংলাদেশে কত প্রকট তা বোঝা যায়৷
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘বিবিএস-এর ওই জরিপ ২০১৬ সালের৷ এরপর আর জরিপ হয়নি৷ তবে আমার মনে হয়না যে বৈষম্য কমেছে, বরং আরো বেড়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘করোনায় নতুন করে দেড় কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন৷ আগে ছিলেন সাড়ে তিন কোটি৷ আমাদের মতো জনবহুল দেশে ২০ শতাংশ মানুষ যদি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেন তাহলে সংখ্যাটি অনেক বড়৷ আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছেনা৷ তার মানে হলো সবার নয়, একটি অংশের আয় বাড়ছে৷ তাই এখন উন্নয়নের সমতার নীতি নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার৷''
উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘‘আমরা বলি উন্নয়ন তো হচ্ছে, এখন একটু বৈষম্য হবে৷ সেটা মেনে নিতে হবে৷ তারপর আস্তে আস্তে কেটে যাবে৷ আমরা বলি হাতের পাঁচটি আঙুল কি সমান হয়, হয় না৷ আমদের মিলে মিশে থাকতে হবে৷ এই যে চাপ, এই চাপ দিয়ে আমাদের দরিদ্র করে রাখা হয়েছে৷''
তারপরও মানুষ কিনছে
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআই'র সাবেক পরিচালক মো, হেলালউদ্দিন জানান, দুই বছর করোনার পর এবার ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনা হচ্ছে কমপক্ষে এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার৷ সারাদেশে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছোট বড় মিলিয়ে ৫৬ লাখ দোকানপাট৷ এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ৷ তার কথা, ‘‘আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে করোনার ধকল কাটিয়ে ঈদ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে৷ অতীতের স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও এবার বেচাবেনা শতকরা ২০ ভাগ বেশি হয়েছে৷''
তিনি দাবি করেন, ‘‘এবার দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ ঈদের কেনাকাটা করছে৷ হয়তো কেউ ২০০ টাকায় একটি জামা কিনেছে, কেউ ২০হাজার টাকায়৷ এই বৈষম্য আছে৷ কিন্তু মানুষ কেনাকাটা করছে৷ যে যার সামর্থ অনুযায়ী করছে৷''
ইসলাম কী বলে?
বিশ্লেষকরা বলেন, ইসলাম যখন এখানে সুফিদের হাত ধরে এলো তখন বড় বড় ড্যাগ বা ডেকচিতে করে রান্না শুরু হলো, খাওয়া হলো৷ এর মানে সবাই মিলে একসঙ্গে খেতে হবে৷
ধানমন্ডি তাকওয়া মসজিদের খতিব মুফতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘ইসলামের বিধানের বাইরে গিয়ে ঈদ উৎসবের নামে ভোগ বিলাসিতায় ডুবে যাওয়ায় ঈদে অর্থনেতিক বৈষম্য আসলেই প্রকট আকারে দেখা দিচ্ছে৷ আসলে এটা ইসলামের বিধান নয়৷ ইসলামের বিধান হলো ত্যাগ এবং সবাইকে নিয়ে আনন্দে শরীক হওয়া৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখন নতুন পোশাক কেনার নামে যাদের টাকা আছে তারা অনেক খরচ করছেন৷ কিন্তু নতুন পোশাক ইসলামের বিধান নয়৷ ইসলামের বিধান উত্তম পোশাক৷ এখন পোশাকের প্রদর্শনী হচ্ছে৷ এটা ঠিক নয়৷ আসলে রমজান মাসে, ঈদে সবচেয়ে বেশি দান করা উচিত৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘যাকাতের নামে ঈদের সময় গরিব মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে কম দামি শাড়ি লুঙ্গি দেয়ার যে প্রতিযোগিতা তাও ইসলাম সমর্থন করেনা৷ যাকাত হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরিবের হক৷ এটা গোপনে দিতে হয়৷ যারা প্রকাশ্যে এটা এভাবে করেন তারা ঈদের সময় বৈষম্য কমাতে অবদান না রেখে বরং বৈষম্য আরো প্রকাশ করে দেন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘যাকাতের আবার আলাদা শাড়ি, লুঙ্গি কীভাবে হয়? আসলে জাকাতের সম্পদে গরিবকে ধনী করে দিতে বলা হয়েছে৷