ঈদের আনন্দ কেড়ে নিলো করোনা আর বন্যা
২০ জুলাই ২০২১ঈদের দিনটি আমাদের অন্যান্য দিনের মতোই কাটে, অর্থাৎ, সারাদিন অফিস করি৷ রাতে সেমাই পোলাও রান্না হয় আর ছুটির দিনে হয়ত কয়েকটি পরিবার কোনো বাড়িতে মিলিত হই, হয় খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা৷ এমনটাই চলছে বহুদিন ধরে৷ কিন্তু গত বছর করোনা এসে পাল্টে দিয়েছে সে নিয়ম৷ আর এবারের ঈদে বাধ সেধেছে বন্যা৷
জার্মানিতে আসার পর পর দেখেছি বাংলাদেশকে বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হিসেবেই জার্মানরা চেনেন৷ সময়ের সাথে বন্যার জায়গা নিয়েছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প৷ সত্যি বলতে কি, আমি সেই বন্যার দেশের মেয়ে হলেও দেশের উঁচু এলাকা ময়মনসিংহ শহরে বেড়ে ওঠায় বানের পানির সাথে কখনো সরাসরি পরিচয় ঘটেনি আমার৷
তবে এবার পরিচয় হলো! গত বুধবার হঠাৎ করেই আমাদের মেয়ে ফোন করে জানালো ওর বাড়ির সামনের পুরো রাস্তা পানিতে ডুবে গেছে৷ আমি তো হতভম্ব! আমরা যেন কিছুতেই ওখানে না যাই, সাবধান করে দিলো সে৷ আসলে কয়েকদিন থেকে অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই বলে এমন ভয়ঙ্কর অবস্থা হতে পারে কোনোদিন কল্পনাও করিনি৷
আমাদের বাড়ি থেকে ওর বাড়ি খুবই কাছে, হেঁটেও যাওয়া যায়৷ এখানে অবশ্য বন্যার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি৷ যা-ই হোক, ঘন্টা খানেক পরে পানি কিছুটা কমে গেলে আমরা ওখানে যাই৷ পরিস্থিতি বুঝে ওঠার আগেই কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার পুরো রাস্তা ডুবে গেল ! আরেকটু বৃষ্টি হলেই হয়ত বাড়ির ভেতরে, মানে বসার ঘরে পানি ঢুকে যেতো! গ্রাউন্ড ফ্লোরে পানি না ঢুকলেও আমাদের চোখের সামনেই বাড়ির বেজমেন্টে পানি ঢুকতে শুরু করেছে৷ বাড়ির জানালা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও জানালার পাশ দিয়ে আসা পানির প্রবল চাপ আমাকে নায়াগ্রা ফলসের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল ৷ বলাই বাহুল্য যে, ঐ বাড়িটিতে এর আগে আমরা পুরো পরিবার কুড়ি বছর ছিলাম, কিন্তু কখনো এমনটা দেখিনি! আসলে আমরা দেখছি সারা বিশ্বে বন্যার প্রকোপ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে গরম৷ আবার শীতও বেড়েছে কোনো কোনো অঞ্চলে৷ আর সেই সাথে সারা বিশ্বে করোনার আগমন! জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবই নাকি এর মূল কারণ, দাবি বিশেষজ্ঞদের৷
যা বলছিলাম, এর আগে জার্মানিতে বন্যা কিছুটা দেখলেও এমন ভয়ঙ্কর বন্যা জীবনে প্রথম দেখলাম, সেটাও আবার নিজেদের বাড়িতে৷ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম হাঁটু জলে নেমে প্রতিবেশীরা একে অপরের খবর নিচ্ছেন, বাড়ির ভেতরের পানি পাম্প করে বাইরে ফেলতে সাহায্য করছেন৷ ফায়ার সার্ভিস এসেছে সাথে সাথেই, বাড়ি চেক করে চলে গেছে যাদের বেশি প্রয়োজন, তাদের কাছে৷ কারণ, একই সময়ে কোলনে প্রায় নয়শ বাড়িতে বৃষ্টির পানি ঢুকেছে৷ পানি পাম্পের কাজে সাহায্য করতে মেয়ের জার্মান বন্ধুরা গভীর রাতেই এসেছে, পরের দিনও এসেছে অনেকে৷ আসলে মানুষের জীবনে ভালো বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকা যে কতটা প্রয়োজন, তা এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে বেশ বোঝা যায়৷
এদেশে বাড়ির বেজমেন্টে দরকারি-অদরকারি বহু জিনিসই রাখা হয়৷ সেরকমই অনেক জিনিস ছিল৷ পানিতে ফার্নিচার, ফ্রিজসহ অনেক কিছুরই ক্ষতি হয়েছে, বেজমেন্ট থেকে ফেলতে হয়েছে জামা কাপড়সহ প্রচুর জিনিস৷ তাতে আমাদের কন্যা খুব বেশি বিচলিত নয়৷ ওর ভাষ্য, " শতাধিক মানুষ মারা গেছেন, শিশুসহ বহু মানুষ আহত হয়েছে৷ বাড়ি-ঘর হারিয়েছেন অনেক মানুষ৷ এতে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে অনেকে৷ সে তুলনায় আমাদের ক্ষতি তেমন বড় কিছু নয়, কাজেই এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই৷”
ওর এই ভাবনা মা-বাবা হিসেবে কিছুটা হলেও আমাদের আশ্বস্ত করেছে৷
গত ঈদগুলোতে করোনা আমাদের ঘরবন্দি রেখেছিল৷ এবার দুটো ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে ভেবেছিলাম ঈদে বন্ধুবান্ধদের নিয়ে একটু হৈ হুল্লোড় করবো, আনন্দ করবো৷ করোনায় ঘরবন্দি জীবনের জমে থাকা কষ্টগুলো খানিকটা লাঘব হবে৷ কিন্তু তা আর হলো কোথায়! বানের পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া জিনিসগুলোর সাথে ভেসে গেছে আমাদের ঈদের আনন্দটুকুও৷