‘ঈদের দিন কারও বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি’
২৩ জুলাই ২০২১কিন্তু আগ্রহ বা উচ্ছ্বাস সবার মধ্যে থাকলেও, উৎসব আয়োজন বা সম্পন্ন করার মূল ভারটি কিন্তু গিয়ে পড়ে নারীদের ওপর৷ বিশেষ করে ঈদ-উল আজহার সময় হাটে গিয়ে পশু কেনার দায়িত্বটি মূলত বাড়ির পুরুষ সদস্যের থাকলেও, উৎসবের আগের দিন থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত নানারকম প্রস্তুতি ও কাজ চলতে থাকে একজন গিন্নীর৷ সময় অনেকটা বদলেছে, নারীদের অবস্থানগত অনেক পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু যেকোনো উৎসবে নারীদের এই দায়িত্ব পালনের বা উৎসব সামাল দেয়ার চিত্রটি কমবেশি এখনো বহাল এবং সেখানে আজও নারীদের অপরাজিত সেঞ্চুরির মতই জয়জয়কার বললে ভুল হবে না৷
এইসমস্ত বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছিল এমন একজনের সাথে যিনি তিন প্রজন্মের উৎসব আয়োজনে এমনটাই দেখে এসেছেন৷ তার নাম সুফিয়া জাহান৷ অভিজ্ঞতার সত্তরটি বছর পার করেছেন তিনি৷
অল্প বয়সে (ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়) বিয়ে হয়ে যায় সুফিয়া জাহানের ৷ পরে আইএ পাশ করে স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন৷ বাবার বাড়ির মতো শ্বশুর বাড়িতেও ছিল যৌথ পরিবার৷ বাড়ির বড় বউ হিসেবে শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদদের নিয়ে সংসারে মূল দায়িত্বগুলো পালন করতে হতো তাকে৷ রান্না কী হবে, কে কে কী পছন্দ করে, অতিথির খাবার, বাড়ির বাজার ইত্যাদি সব চিন্তাই ছিল তার৷ চাকরির পাশাপাশি সংসার সামাল দেয়া, বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন-এসব দায়িত্বের মাঝে নিজের কোনো শখ বা বেড়ানোর ইচ্ছে কোনদিন পূরণ করার করার কথা ভাবতেই পারেননি৷
তাইতো যখন প্রশ্ন করলাম, "এত ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে গেল এবং বাড়ির বড় বউ হয়ে গেলেন আপনি৷ ঈদের মত এমন উৎসব এলে কীভাবে সামাল দিতেন?”
জবাবে সুফিয়া জাহান বলেন, "আগের রাত থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করতাম৷ আমি বাড়ির বড় বউ ছিলাম৷ অনেক দায়িত্ব ছিল৷ ঈদের দিন বা পরের দিন দেবর- ননদ, অন্যান্য মেহমান আসতো৷ রান্না করা, তাদের নিয়ে আনন্দ করা-এসব চলত৷ তবে একটা জিনিস মনে হত, ঈদের দিন কখনো কারও বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হয়নি৷ কারণ চিন্তা ছিল আমাদের বাসায় মেহমান এসে তাহলে আমাকে পাবে না৷ তাই কোথাও যাওয়া হত না৷ তবে এটা নিয়ে কোনদিন সংসারে অশান্তি করিনি৷ ”
স্মৃতিচারণ করতে করতে ৪০/৫০ বছর পেছনে ফিরে তিনি বলতে থাকেন, "চাকরি, সংসারের কাজ৷ অনেক কষ্ট হত৷ কিন্তু কষ্টের মাঝেই আনন্দ খুঁজে নিতাম৷ বাড়ির কাজ করে স্কুলে পড়াতে যেতাম, ছোট ছোট বাচ্চারা ছিল, তারপরও যত কষ্টই হোক, সবাইকে নিয়ে উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেয়ার মধ্যেই তখন আমাদের আনন্দ ছিল৷''
এই যে "কষ্ট হলেও আনন্দ খুঁজে নেয়ার” মানসিকতা যে উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করেন এই অঞ্চলের নারীরা! কারণ সুফিয়া জাহানও অন্য আর সব বাঙালি মেয়ের মতো নিজের মা-দাদী-নানী-চাচীদের এই রূপেই দেখে এসেছেন৷
ফলে উৎসবের রাত-দিন তাদের একাকার হয়ে কেটে যায় হেঁশেলেই৷ হয়তো সেখানেই কখনো খেয়ে নিয়েছেন৷ সারাদিন কাজ করে ঘামে ভিজে শেষ বিকেলে গা ধুয়েছেন৷ আর বাড়ির পুরুষ বা কর্তারা হাট থেকে বাজার করে বা কোরবানির পশু কিনে এনে যথেষ্ট ক্লান্ত৷ কিন্তু উৎসবে যেন নারীর ক্লান্তি আসেই না!
সুফিয়া জাহান বলছিলেন, "আমাদের বাবার বাড়িতেও যৌথ পরিবার ছিল৷ বাবা-কাকা-মা-চাচীদের নিয়ে৷ সেখানে মা-চাচীদের দেখেছি সারাদিন তাদের নানারকম রান্না, ঘর গোছানো, সাজানো, নারকম পদ দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন, গভীর রাতে ক্লান্ত শরীরে ঘুমাতে যাওয়া-সেসব দেখে বুঝিনি তাদের আসলে কত কষ্ট করতে হতো৷ নিরে যখন বিয়ের পরে চাকরি, যৌথ পরিবারের নানান দায়িত্ব পালন শুরু করলাম তখন বুঝলাম সংসার আসলে কত কঠিন!”
‘সংসার আসলে কত কঠিন'-তিনি মুখে বলছেন বটে, কিন্তু এখনো সময় পেলে চলে যান রান্নাঘরে৷ বয়স ৭১ বছর৷ হলে কী হবে! উৎসবের বিশেষ কোন পদ রান্না, বৌমাকে দেখিয়ে দেয়া-এ যেন তাকে এখনো ফিরিয়ে নিয়ে যায় তার কমবয়সের চপলতার দিকে৷ তাই তো যখন জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি যেহেতু কর্মজীবী ছিলেন, সেখানে সংসারের কাজে স্বামীর তরফ থেকে কোন সহায়তা কি পেয়েছেন কখনো? বা আশা করেছেন?”
জবাবে তিনি বলেন, "আসলে আমাদের সময়ে পুরুষেরা তো ততটা সচেতন ছিলেন না৷ আমাদের মা-চাচীদের সময় তো অবস্থা আরো খারাপ ছিল৷ পুরুষেরা সেসময় হয়তো মনে করতেন, সংসারের ভেতরের কাজগুলো মেয়েরাই করবে৷ আর এটাও ঠিক যে সংসারের কাজ একটি মেয়ে যেভাবে করতে পারে একজন পুরুষ সেভাবে পারবে না!”
তো এই হলো মোদ্দা কথা! নারী নিজেও মনে করে তার চেয়ে ভালো এই দায়িত্বগুলো আর কে পারবে৷
যদিও বর্তমান যুগে সংসারের কাজ ভাগ করে নেয়ার মানসিকতা অনেক মানুষের মধ্যেই গড়ে উঠছে৷ অনেক পরিবারে রান্না শুধু মেয়েদের কাজ- এমনটি আর ভাবা হয়না
সুফিয়া জাহান জানান, তাদের পরিবারেও সে পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে এখন৷ তার পুত্রবধু কর্মজীবী একজন নারী এবং মাঝে মাঝেই তার ছেলেটি স্বেচ্ছায় রান্না-বান্না করে৷
তবে যেকোন উৎসব আয়োজনে সিংহভাগ কাজ করেন পরিবারের মেয়েরা৷ একথা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ শহর-গ্রামভেদে এখনো বাড়িতে বাড়িতে উৎসবের সেই একই চিত্র৷
চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরে এই নারী এখন ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে সময় কাটান৷৷ পুত্রবধূ বিমানে চাকরি করেন তাই মাঝে মাঝেই তাকে দেশের বাইরে উড়াল দেওয়ার সুযোগ মেলে৷ ছেলে-মেয়েরা এখন আর তাকে সংসারের কাজে ব্যস্ত রাখতে চায় না৷ কিন্তু এখনো উৎসব এলে আর বসিয়ে রাখা যায় না তাকে৷ সুযোগ পেলেই ঢুকে যান রান্নাঘরে৷ তার সাথে যেদিন ধানমন্ডি এলাকায় ছেলের বাসায় কথা হচ্ছিল সেদিনের রান্নাগুলো সব তিনিই করেছেন৷ সেকথা বলছিলেন বেশ আনন্দ নিয়েই৷
অনেক সময় তর্কযুদ্ধে অনেকেই দাবি তোলেন, নারীর ওপর রান্নার ভার চাপিয়ে দিয়ে তাকে শৃঙ্খলে বেধে রাখা হয়েছে৷ তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এই দায়িত্ব৷ কিন্তু আসলে কি নারী নিজে এই দায়িত্বের শৃঙ্খল থেকে পুরোপুরি বের হতে চেয়েছে ? নাকি নির্ভরতার কাজের মাঝে নিজের শান্তি খুঁজে নিয়েছে৷ সে তর্কের বিষয়বস্তু৷ কিন্তু এই বয়সে এসেও রান্না করতে যে তার এখনো ভালো লাগে সেকথা বলছিলেন সুফিয়া জাহান নিজে, "আমি ঈদ এলে বসে থাকি না৷ এমনিতে তেমন রান্না-বান্না করি না৷ কিন্তু ঈদের সময় আমিও কিছু কিছু রান্না করি৷ হয়তো বৌমা বোঝে না তখন বলে মা এটা আপনি করেন৷ সেটা করি, আমারও ভালো লাগে৷ ঈদের দিনও আমি বৌমার সঙ্গে রান্না করলাম৷ কোন অনুষ্ঠানে আমি ছোটখাট কাজে হলেও হাত লাগাই”৷
উৎসবে হোক আর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা-ই হোক, ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর নিয়ে এখনো অফিস থেকে ফেরা নারীটি বা হোমমেকার ঘরোয়া বধূটি কীভাবে উৎসবে নতুন কিছু রেসিপি করবেন, ঘরের অন্দরের সাজসজ্জা আরও ভিন্ন করবেন তা নিয়েই ভাবেন৷ কখনও নিজে ভেবে কখনও ইউটিউব বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে এই কর্মপরিকল্পনা তার চোখে-মুখে ক্লান্তির বদলে প্রশান্তির উৎসবে বর্ণময় হয়৷ বাংলার উৎসবে নারীর তাই উৎসবের প্রাণ৷