সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে মেয়েরা'
২৭ জুলাই ২০১৫বাংলাদেশে পারিবারিক ও সামাজিক বহু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে৷ তার মধ্যে মেয়েদের সার্ফিংয়ে আসা সহজ ছিল না৷ নাসিমা আক্তার নামে ১৮ বছরের এক দুরন্ত কিশোরী সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে গৌরবের পথে দৃপ্ত পায়ে প্রথম এগিয়েছেন৷ বঙ্গোপসাগরের বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা ছিল৷ মিতালি গড়ে উঠেছিল সমুদ্রের সঙ্গে৷ তিনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়, যদিও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি তাঁর সার্ফিং কেরিয়ার৷ বছর দেড়েক আগে তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেন গরিব পিতা৷ আর সেই থেকে সার্ফিং থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান নাসিমা৷
তবে নাসিমা চলে গেলেও ততদিনে অন্য মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে সার্ফিং৷ দেশি-বিদেশি মানুষের নজর পড়েছে কক্সবাজারে মেয়েদের সাফিংর দিকে৷ এরপর নতুন করে মেয়েদের খুঁজতে শুরু করে সার্ফিং ক্লাবগুলো৷ পেয়েও যায়৷ তাদের একজন রিপা আক্তার (১২)৷ গত ২৭শে এপ্রিল কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত মেয়েদের সার্ফিং প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে সে৷ অথচ বছর দু'য়েক আগেও সমুদ্রসৈকতের ধারে পানির বোতল, চিপস আর ঝিনুকের মালা বিক্রি করত রিপা৷
দুই বোনের মধ্যে রিপাই বড়৷ তাই পরিবারের চাপ ছিল৷ তারপরও ধীরে ধীরে নামকরা সার্ফার হয়ে উঠেছে সে৷ রিপা নিজেই শুধু সার্ফিং করছে না, এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পরিবারকেও সহযোগিতা করছে৷ নিজে পেয়েছে নতুন সার্ফিং বোট৷
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে রিপা জানাল, ‘‘বিচের ধারে পানির বোতল, চিপস ও ঝিনুকের মালা বিক্রি করার সময় ছেলেদের সার্ফিং করতে দেখতাম৷ আমরা পানিতে নামতে চাইলে বোট দিত না৷ কিন্তু ওরা সার্ফিং শেষে চলে গেলে আমরা বোট খুলে পানিতে নিয়ে খেলতাম৷ সেই থেকে শুরু৷ এখন অবশ্য রাশেদ ভাই ও শিফাত ভাই সহযোহিতা করেন৷''
কক্সবাজারের মৌসুমী হকার জাহাঙ্গীর আলম ও গৃহীনি কাজল বেগমের ছোট মেয়ে, রিপা আক্তারের ছোট বোন রিতাও সার্ফিং শুরু করেছে৷ শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে শুকনোছড়িতে (নতুন নাম মুজিবনগর) তাদের বাড়ি৷
সার্ফিংয়ের ঐ প্রতিযোগিতায় রানার্সআপ হয়েছে শবে মেহেরাজ (১৩)৷ দিনমজুর জাফর আহমেদ ও গৃহীনি বেবী আক্তারে চার মেয়ে, দুই ছেলের মধ্যে মেহেরাজ চতুর্থ৷ শহরের কাছে ঘোনারপাড়া তার বাড়ি৷ মেহেরাজের সার্ফিংয়ে আসার কাহিনি রিপারই মতো৷ শুধু রিপা বা মেহেরাজ নয়, সার্ফিংয়ে জড়িত সব কিশোরীর ‘লাইভ সেভিং' প্রশিক্ষণ রয়েছে৷ তাই এখন তারা শুধু তীরে নয়, সাগরের মধ্যেও সার্ফিং করতে যেতে পারে, অসুবিধা হয় না৷
‘কক্সবাজার লাইফ সেভিং সাফিং ক্লাব'-এ পুরুষ-নারী সবাই সাফিং করে৷ এই মুহূর্তে ১১ জন কিশোরী সাফিংয়ের সঙ্গে যুক্ত, যাদের মধ্যে আটজন বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে৷ ক্লাবের সহ-সভাপতি শাহ মোহাম্মদ সাইফুল্লা শিফাত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মেয়েদের এখানে আনা সহজ ছিল না৷ এখনও ধরে রাখা কঠিন৷ অ্যামেরিকার এলিয়ান্ট নামে এক নারীর অনুদানে এখনো আমরা কয়েকটি মেয়েকে ধরে রাখতে পেরেছি৷ উনি আমাদের অনুদান পাঠান৷ আর সেই টাকা থেকেই আমরা প্রতিটি মেয়েকে মাসে আড়াই হাজার টাকা করে দেই৷ পাশাপাশি পোশাক ও বোটগুলো দেয়া হচ্ছে সেই অনুদানের টাকাতেই৷''
তবে অনুদান বন্ধ হয়ে গেলে এই মেয়েদের আর ধরে রাখা যাবে কিনা – তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এই কর্মকর্তা৷ তাঁর কথায়, ‘‘গরিব পরিবারের এই মেয়েদের বয়স একটু বাড়লেই পরিবার থেকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়৷ ফলে নতুন নতুন কিশোরীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এখানে আনতে হচ্ছে৷ আগাগোড়া মেয়েদের ধরে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ৷''
‘কক্সবাজার লাইফ সেভিং সাফিং ক্লাব'-এর সভাপতি রাশেদ আলম৷ তিনি বলেন, ‘‘মেয়েরা সমুদ্রসৈকতে কাজ করত৷ তারা পানি, চিপস এবং ডিম বিক্রি করত৷ তাদেরই আমরা সার্ফিংয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করলাম৷ কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের মা-বাবা৷ কারণ তাদের উদ্দেশ্য ছিল আয় করা৷ দুই ঘণ্টা সার্ফিংয়ে সময় দেয়ার চেয়ে মা-বাবারা দুই ঘণ্টার আয়কেই বড় করে দেখেন৷ এ জন্য কাজটি খুব ধীরে এগোচ্ছিল৷''
তিনি বলেন, ‘‘মেয়েরা স্কেটিং করছে, সার্ফিং করছে, শিখছে৷ তারা নিজেদের জীবন নিজেরাই রক্ষা করছে৷ আমার বিশ্বাস, তাদের এই প্রচেষ্টা তাদের পরিবারের স্বপ্নেও একদিন পরিবর্তন ঘটাবে৷ অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের নিয়ে কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখবেন৷ আর মেয়েরা পরিবারে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে৷'