উৎসবে বিদেশে দাম কমে, বাংলাদেশে বাড়ে কেন?
২৮ এপ্রিল ২০২২দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বাজারের দ্রব্যমূল্যের উঠানামার বিষয়টি ফলো করেন সাংবাদিক আতিক ফয়সাল। তার মতে, ঈদ বা অন্য উৎসবে যে সব পণ্যের চাহিদা বাড়ে, সে সব পণ্যের দামও বাড়ে। এটাই যেন বাংলাদেশের বাজারের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে।
রোজার ঈদে দাম বাড়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে, নতুন জামা কাপড়, সেমাই, মিষ্টান্ন, ফলফলাদি ইত্যাদি।
দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তিনি বলেন, গরুর মাংস যেখানে ৫০০-৫৫০ টাকা ছিল, সেটা রোজা ও ঈদে বেড়ে ৭০০টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মুরগী খাসির মাংসের দামও ৫০-১০০টাকা করে প্রতি কেজিতে বেড়েছে। সেমাই-চিনির দামও বেড়েছে। পোলাও-বিরিয়ানির চাল চিনিগুঁড়ার চাল কেজিতে কোথাও কোথাও ২০ টাকাও বেড়েছে।
"ফ্যাশন হাউজগুলোতে পোশাকের দাম বাড়িয়ে দিয়ে সেখানে নতুন করে আবার ডিসকাউন্টের প্রচলন আমরা দেখতে পাই।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য জাপানে গিয়েছিলেন নাদিম মাহমুদ। পিএইচডি শেষ করে এখনো তিনি সেখানেই গবেষণা কাজে নিয়োজিত আছেন।
ড. নাদিম মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, হ্যালোউইন, বড়দিন, নতুন বছর উদযাপনে জাপানিরা বেশ উৎসাহী। এছাড়াও এই দেশে প্রতি বছর, মে, অগাস্ট এবং ডিসেম্বরে প্রায় তিন-চারদিন করে ছুটি থাকে।
মূলত এইসব উৎসব ও ছুটিতে জাপানের শপিং মলগুলোতে উপচে পড়া ভিড় থাকে। দোকানিরা বিশেষ ছাড় দিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করে।
তিনি বলেন, গত আট বছর ধরে জাপানে আছি, আমি কখনোই দেখিনি, এইসব দিনগুলোতে কোন জিনিসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বরং ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে প্রায়ই লোভনীয় অফার থাকে। তাতে ক্রেতা কখনোই ঠকে না। বরং লাভবান হয়।
"শুধু তাই নয়, সামার কিংবা ইয়ার এন্ড ছুটিগুলোতে তৈরি পোশাক, জুতা ব্যতীত ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ও ব্যক্তিগত গাড়িতেও বিশেষ মূল্য ছাড় দিতে দেখেছি। সবচে মজার বিষয় হলো, যতদিন পর্যন্ত এইসব ক্যাম্পেইন চলে, এই সময়ের মধ্যে জিনিস কিনতে গিয়ে 'স্টক শেষ' হয়ে গেছে- এমন কিছু ক্রেতাকে শুনতে হয় না। বরং আপনি যতটুকু চান, তা পেয়ে যাবেন।”
জার্মানির বার্লিনে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশি চাঁদ সুলতানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, এতদিনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি ক্রিসমাসের সময় জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। কাপড় থেকে শুরু করে খাবার- সবকিছুতে প্রচুর অফার থাকে।
তবে ঈদ নিয়ে জার্মানিতেও তার কিছুটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের উৎসব মানে ঈদ-রোজায় খেজুর-দই-মিষ্টি, এসবের দাম একটু বেড়ে যায় টার্কিস- এরাবিয়ান-এশিয়ান শপগুলোতে।
ক্রিসমাসে দাম না বাড়লে ঈদে কেন দাম বাড়ে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার মনে হয় এটা কালচারাল ব্যাপার। এশিয়ান অথবা মুসলিমরা এই সময়ে একটু ব্যবসা করতে চায়।
ঈদে কোন কোন পণ্য বা সেবার দাম বাড়ে-তা জানতে ঢাকা ভিত্তিক একটি জনপ্রিয় ফেসবুক গ্রুপে একটি পোস্ট দেয়া হয়। সেখানে একাধিক ব্যক্তি মন্তব্যে উঠে আসে যে, ‘ঈদে আসলে কোন কোন পণ্য বা সেবার দাম বাড়ে না-সেটা বলা সহজ।'
হাফিজ মোল্লা নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন শিক্ষার্থী সেখানে মন্তব্য করেন, এবার দেখলাম,পোশাকের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। রোজার আগে মেয়েদের কিছু জামা যে দামে দেখলাম, কাল গিয়ে দেখি তিনগুণ।
আরেকজন সেখানে মন্তব্য করেন, কীসে বাড়ে না? নরমাল রুমাল কিনতে গেছি, সেইখানেও দেখি ১০/২০ টাকা পার পিস বাড়ায় রাখছে।
আরেকজন সেখানে মন্তব্য করেন, ‘সবকিছুই! ইভেন লোকাল বাস ভাড়াও দ্বিগুণ নেয়।'
ভোক্তাদের অধিকার সংক্রান্ত নানা ব্যক্তিক্রমী উদ্যোগ নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনায় থাকা কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি (সিসিএস) এর নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, উৎসব এলে ব্যবসায়ীদের কুপ্রবৃত্তি জেগে উঠে। এক ধরনের লুণ্ঠনের মানসিকতা জেগে উঠে। ভোক্তাকে তারা কেবল উপার্জনের উপাদান মনে করে। যেভাবেই হোক, পণ্যের মূল্য বেশি নিয়ে বা নিম্নমানের পণ্য দিয়ে বেশি মূল্য নেয়া, ভোক্তাদের ঠকানো ইত্যাদি উপায়ে টাকা রোজগারের কুপ্রবৃত্তি জেগে উঠে।
"এটা এক দুইজন বা একটি দুইটি প্রতিষ্ঠানের হয়- তা নয়। বরং এটা দেশব্যাপী হচ্ছে। অনেকটা সামাজিকীকরণ হয়ে গেছে যে, যখন কোন উৎসব আসবে। তখন সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা লুটপাট করা শুরু করবে।”
"দাম বৃদ্ধির একটা ভয়াবহ প্রবণতা এবার দেখা গেছে। বিশেষ করে, বড় বড় ব্র্যান্ড যেমন বাটা, এপেক্স, আর্টিজান, স্মার্টেক্স-তারা তাদের পণ্যে আগের মূল্যের উপর নতুন করে মূল্য বসিয়ে বিক্রি করেছে। এটা একটি দুইটি শাখায় নয়। সারাদেশে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় তারা জরিমানার মুখেও পড়েছে। আস্থার ব্র্যান্ডগুলোও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে।”
"মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা এত বেশি যে, কত মানুষকে শাস্তি দেয়া সম্ভব! সেটা করতে গেলেও সমস্যা আছে। মূল্যবৃদ্ধির এই বিষয়টি দেখার দায়িত্ব ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। তাদের জনবল খুবই কম। প্রতিটি জেলায় কর্মকর্তা একজন করে। তিনি যদি সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একবার করে ঘুরে আসতে চান, এক বছরেও পারবেন না।”
"এই পরিস্থিতি থেকে সহজে উত্তরণের উপায় নেই। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা। আর ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের জনবল বাড়ানো, তাদের ক্ষমতা বাড়ানো এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া।”
বাংলাদেশের ভোক্তাদের নিয়ে কাজ করা ঐতিহ্যবাহী সংগঠন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, মৌসুমে এসে দাম বাড়ানোর কোন বিধান আমাদের দেশের আইনে নেই।
"বরং ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণেই নানা রকমের আইন আছে।
দৃষ্টান্ত হিসাবে তিনি বেশ কিছু আইনের কথা উল্লেখ করেন, যার মধ্যে রয়েছে, ভোক্তা সংরক্ষণ আইন, নিরাপদ খাদ্য আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, বাংলাদেশ কম্পিটিশন কমিশন আইন, বিএসটিআই আইন।
তিনি বলেন, গুদামজাত করা নিয়ে আরেকটি আইনের খসড়া হয়েছে। আশা করি, সেটাও পাস হয়ে যাবে।
নাজের হোসেন বলেন, আইন থাকলে কী হবে, আইনের প্রয়োগ সমভাবে হয় না। প্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন, বড় ব্যবসায়ী-তাদের জন্য এক ধরনের আইন। সাধারণ লোকের জন্য আরেক রকমের প্রয়োগ। যার কারণে আমাদের ব্যবসায়ীরা আইনের তোয়াক্কা করেন না।”
প্রতিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভোক্তা হিসাবে আমাকে জানতে হবে, আমি কোন কোন জায়গায় ঠকতেছি বা প্রতারিত হচ্ছি। এটা না জানলে তাহলে কিন্তু আমি প্রতিকার চাইতে পারবো না। এখানে যেমন ধরেন, ভোক্তা সংরক্ষণ আইনে প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সহজ বিধান বলা আছে। এই আইনটি এক্সক্লুসিভলি ভোক্তাদের জন্য।
"সেই কারণে আপনি যদি মনে করেন, কোন এক জায়গায় আপনি পণ্য বেশি দামে কিনছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাহলে আপনি তখন কেনার রশিদসহ ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে পারেন।”
তিনি বলেন, কেউ এটা নিজে করতে না চাইলে আমাদেরকে দিলে আমরাও তার পক্ষ থেকে সেটা করে থাকি। আমাদেরকেও সেক্ষেত্রে রশিদ দিতে হবে এবং অভিযোগটা জানাতে হবে।
"ক্যাব পরে সেটা যথাযথ কর্তৃপক্ষ যেমন, ভোক্তা সংক্রান্ত হলে ভোক্তা অধিদপ্তরে,ওষুধ সংক্রান্ত হলে ওষুধ প্রশাসনে, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে, টেলিফোন-মোবাইল সংক্রান্ত বিষয় বিটিআরসিতে, এনার্জি সংক্রান্ত হলে বিএআরসিতে পাঠায়।”
ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ সংশোধনের পাশাপাশি অধিদপ্তরের ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপে সীমিত সামর্থের কথা স্বীকার করলেও ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান।
তিনি বলেন, ভোক্তা অধিদপ্তরের লাইন মিনিস্ট্রি যেহেতু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ যেহেতু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। তাই এক সময় ভোক্তা অধিদপ্তরও কেবল নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়েই কাজ করবে-এমন একটা জনমানস গড়ে উঠেছিল।
কিন্তু সেটা থেকে বেরিয়ে বেনারশি পল্লী, বিখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকানে অভিযান পরিচালনার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। তাদের এই অভিযানে মানুষ সচেতন হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, তরমুজের শ পিস একত্রে কিনে কেজি দরে বিক্রির বিষয়ে অভিযানের পর মানুষ এখন বলছে, আমাকে দুই কেজি তরমুজ দেন। ট্রলও হচ্ছে এটা নিয়ে। এটা কিন্তু অভিযানের ফল।
"আমাদের অভিযানগুলো আসলে বলতে পারেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রতীকী অভিযান। সক্ষমতার বিষয়ও আছে। জেলা পর্যায়ে আমাদের একজন এডি এবং একজন কম্পিউটার অপারেটর। একটি জেলায় ১০-১২টা উপজেলা আছে। প্রতিটা জায়গায়তো অভিযান পরিচালনা করার সুযোগ আসলে ওইভাবে হয় না। ”
"তবে আমি জনবলের স্বল্পতা বা সীমাবদ্ধতার কথা বলবো না। আমাদের বড় কাজ হচ্ছে, ভোক্তারা যখন সচেতন হবে, তখন প্রতিটা ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।”
অন্য সরকারি অফিসগুলোর চেয়ে ভিন্নভাবে চলতে চাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ডিজিটাল কনটেন্ট দিয়ে মানুষকে সচেতন করতে চাই। অভিযোগকে অটোমেশনে নিয়ে আসতে চাই। এ জন্য আমরা একটা অ্যাপও তৈরি করেছি। আগামী মাসে এটা উদ্বোধন হবে। ইউজার ফ্রেন্ডলি উপায়ে যাতে মানুষ অভিযোগ করতে পারে।
"আমাদের পরিকল্পনা করছি, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে উন্নত বিশ্বের মতো ভোক্তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে।”