এ পুলিশ কেমন পুলিশ?
১ জানুয়ারি ২০২১কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনার উল্লেখ করতে চাই৷ শুরু করা যায় কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাতের মন্তব্য দিয়ে৷ ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে এক সমাবেশে এসপি হুমকি দেন, ‘‘কঠোরভাবে বলতে চাই, পরবর্তীতে এমন কোনো ঘটনা যদি ঘটে, সরকারকে একদম দুর্বল মনে করবেন না মৌলবাদী চক্র৷ হাত কিন্তু ভেঙে দিব৷''
শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশকে অনেক সময় কঠোর হতে হয়, সেটা মানি৷ কিন্তু সেটা তিনি করবেন আইনের ধারার মধ্যে থেকে৷ যারা ভাস্কর্য ভাঙার হুমকি দিয়েছে, যারা ভাঙছে, যারা নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তাদের আইনের মাধ্যমেই গ্রেপ্তার ও সাজা দেয়া সম্ভব৷ কিন্তু তা না করে একজন রাজনৈতিক নেতার মতো সমাবেশে ‘হাত ভেঙে দেয়ার' হুমকি দিয়ে পুলিশ সুপার বরং আইনের প্রতিই শ্রদ্ধা দেখালেন না৷
পুলিশ সুপার হয়তো ভুলে গেছেন তিনি সরকারের কর্মচারি না, রাষ্ট্রের কর্মচারি৷ সরকারের কেউ অন্যায় করলেও রাষ্ট্রের কর্মচারি হিসেবে আইনের সঠিক বাস্তবায়ন তার দায়িত্ব৷ ফলে ‘সরকারকে একদম দুর্বল মনে করবেন না' বলে যখন একজন পুলিশ সুপার হুশিয়ারি দেন, এ নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয় বই কি৷
এদিকে, রংপুরের সিআইডির পুলিশ সুপার মিলু মিয়া বিশ্বাস এক দম্পতিকে গ্রেপ্তার করে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করেছেন৷ তাদের অপরাধ, ডাক্তার হয়েও এক নারী একজন নাপিতকে স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছেন৷
সেই নারী বারবারই বলছেন যে তার আগের স্বামীকে তিনি তালাক দিয়েছেন এবং বর্তমান স্বামীকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছেন৷ কিন্তু পুলিশ তা মানতে নারাজ৷ তারা নারীর বাবার দায়ের করা ‘অপহরণ' মামলাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, যাকে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে, তার বক্তব্যকে নয়৷
শিশুসহ তাদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা কেবল মানবাধিকারই লঙ্ঘন হয়নি, এমন না করতে আদালতের নির্দেশও অমান্য করা হয়েছে৷
তবে তার চেয়েও আশঙ্কার কথা হলো, ডাক্তার এবং নাপিতের মধ্যে বিয়ে নিয়ে পুলিশ সুপার যা ভাবছেন৷ নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, ‘‘এই খবরটা যদি প্রকাশ না হয়, বোধোদয় না হয়, তাহলে সমাজের আরেকজন ডাক্তার আরেকজন চাকরের সাথে চলে যাবে৷''
শুধু তাই নয়, ডাক্তারদের অভিভাবকদেরও তিনি পরামর্শ দিয়েছেন নজর রাখার৷ তার পরামর্শ, যাতে নজর রাখা হয়, যাতে ‘চাকরবাকরের সঙ্গে কন্টামিনেশন' না হয়৷ এমন সব মন্তব্য দেয়ার পর তিনিই আবার ডাক্তারের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন৷ সাংবাদিককে তিনি বলছেন, ‘‘এ শিক্ষার কী মূল্য আছে বলেন৷ ডাক্তার হয়ে চাকরের সাথে চলে যেতে হবে?''
হায়রে শিক্ষা! হায়রে নৈতিকতা!
এবার আসি রাজধানীতে৷ নবাব এলএলবি সিনেমায় ‘পুলিশকে খারাপভাবে দেখানো' এবং ‘অশ্লীল ভাষা' ব্যবহারের দায়ে পর্নোগ্রাফি মামলায় সিনেমার পরিচালক ও এক অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷
কী অসাধারণ এক দেশে বাস করি আমরা!
সিনেমাতে এক ধর্ষণের শিকার নারী পুলিশের কাছে অভিযোগ দিতে গিয়ে হেনস্থার শিকার হন৷ সেখানে পুলিশ অফিসারের মুখে কিছু সংলাপ বসানো হয়েছে যা আমরা অমার্জিত গালি বলেই চিহ্নিত করি৷ এবং আমার কাছে মনে হয়েছে কেউ যদি ধর্ষণের শিকার নারীকে আরো হেনস্থা করতে চায়, এ ভাষাতেই করবে৷
শুধু পুলিশনয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদের নীচে মন্তব্য পড়লেই বোঝা যায় কী বিশাল সংখ্যক মানুষ ধর্ষণের জন্য নারীকেই দায়ী মনে করে এবং প্রকাশ্যে এর চেয়েও বাজে ভাষা ব্যবহার করে অনেক পাঠক সেটা জানান দেন৷ ফলে নারীকে বাস্তবে যেভাবে হেনস্থা-হয়রানির শিকার হতে হয়, তাই দেখানো হয়েছে৷
পুলিশ নিজে অস্বীকার করতে পারবে যে এসব অভিযোগ বাস্তবেতাদের বিরুদ্ধে নেই? অন্য কিছু প্রয়োজন নেই, গুগলে ‘পুলিশ ধর্ষণ' লিখে সার্চ দিয়ে দেখুন৷
পুলিশ জনগণের বন্ধু হতে চায়৷ কিন্তু সেটা কি মানুষকে ধমকিয়ে, হাত ভেঙে দেয়ার হুমকি দিয়ে, গ্রেপ্তার করে সম্ভব? পুলিশকে স্বীকার করতে হবে অন্য সব পেশার মতো তাদের মধ্যেও অনেকেই আছেন যারা পুরো বাহিনীর নাম খারাপ করছেন৷ সে মানুষদের চিহ্নিত করতে হবে, কাজগুলো চিহ্নিত করতে হবে৷
তবে সরকারের পুলিশ-নির্ভরতা দিন দিন বেড়ে চলেছে৷ কেবল নির্বাচনই নয়, আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বইমেলায় কী বই প্রকাশ হবে, কোথায় কে সমাবেশ করতে পারবে বা পারবে না সবই ছেড়ে দেয়া হয়েছে পুলিশের অধিকারে৷
ফলে পুলিশও ক্ষমতা পেয়ে আইনী কাঠামোর বাইরে গিয়েও এখন মোরাল পোলিসিং বা নীতিপুলিশেরদায়িত্ব পালন শুরু করেছে৷ কে কাকে বিয়ে করবে, সিনেমায় কী সংলাপ থাকবে, কার চুলের রঙ কী হবে, কে কোথায় কার সঙ্গে বসতে ও ঘুরতে যেতে পারবে ইত্যাদিও এখন পুলিশ ঠিক করা শুরু করে দিয়েছে৷
ক্যামব্রিজ ডিকশনারি বলছে, ‘যে রাষ্ট্রের সরকার মানুষের স্বাধীনতা ব্যাপক হারে খর্ব করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করে', তাকেই পুলিশী রাষ্ট্র বলে
একটা সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন হতে পারে না৷ ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু', এটা পুলিশ না বলে জনগণকে বলতে দিলে ভালো হয় না?