একজনের ভোট নিতে যাবেন ১০ জন!
২৭ মার্চ ২০১৯এই দুই ভোটারের একজন হলেন সকেলা তায়াং৷ তিনি থাকেন চীন, মিয়ানমার ও ভুটানের সীমান্তবর্তী অরুণাচল প্রদেশে৷ অন্য ভোটার ভারতদাস দর্শনদাসের বাস পাকিস্তান লাগোয়া গুজরাট রাজ্যের গির অভয়ারণ্যে৷
এই দুই ভোটারের মধ্যে ব্যবধান প্রায় ৩,৫০০ কিলোমিটার৷ তাঁরা একজন আরেকজনকে চেনেন না৷ কিন্তু ৯০ কোটি ভোটারের দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের উৎসবে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে একই ভূমিকায় দেখা যাবে দুই প্রান্তের দুই ভোটারকে৷
১১ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে ভারতের সাধারণ নির্বাচন৷ এবার নির্বাচন কমিশনের স্লোগান, ‘কেউ বাদ নয়, কারও ভোট বাদ নয়৷’ এই স্লোগানকে বাস্তবায়িত করে তুলতে অরুণাচল প্রদেশ ও গুজরাট রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনি আধিকারিকের দপ্তর বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে৷
সকেলার জন্য
অরুণাচলের রাজধানী ইটানগর থেকে ৩০০ মাইল দূরে আনজাও জেলা৷ সেখানকার একটি গ্রামের নাম মালোগাম৷ প্রধান সড়ক থেকে সেখানে যেতে ২৪ মাইল পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়৷ এই পথ যেতে ভোটকর্মীদের প্রায় ১১ ঘণ্টা সময় লাগবে৷
৩৯ বছর বয়সি সকেলা একজন গৃহবধূ৷ স্বামী, সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন চীন, মিয়ানমার ও ভুটান লাগোয়া ওই গ্রামে৷ গতবার তাঁর স্বামীও ভোট দিয়েছিলেন৷ এবার যে-কোনো কারণেই হোক অন্য বুথে স্ত্রীর নাম স্থানান্তর করিয়েছেন তাঁর স্বামী৷ তবে, আগের মতোই ভোট দেবেন সকেলা৷
অরুণাচল রাজ্য নির্বাচন দপ্তরের নোডাল অফিসার লর্ড তাকার ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ‘‘একজন ভোটার বলে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের আয়োজন কম হবে, এমনটা নয়৷ কমিশনের নির্দেশিকা মেনে সব ব্যবস্থাই করতে হচ্ছে৷ ‘একজন ভোটারও যেন বাদ না পড়ে’ কমিশনের এই স্লোগানকে সামনে রেখে আমরা সব ব্যবস্থা করছি৷ ১০ থেকে ১৮ জন ভোটকর্মী মালোগামে গিয়ে সকেলার ভোট গ্রহণ করবেন৷’’
রাজ্যের ডেপুটি নির্বাচন কমিশনার লিয়েন কোয়ু জানিয়েছেন, ‘‘রাজ্যে মোট ২,২০২ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের মধ্যে সাতটি এমন ভোটগ্রহণ কেন্দ্র এমন আছে, যেখানে মোট ভোটারের সংখ্যা ১০ জনের চেয়ে কম৷ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ভোট গ্রহণের দিন, ১১ এপ্রিল সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ কেন্দ্র খুলে রাখতে হবে৷ নির্বাচন কর্মী ও অফিসাররা আগের দিন, অর্থাৎ ১০ এপ্রিল রওনা হবেন৷ জানা নেই, সকেলা কখন ভোট দিতে আসবেন৷ আগেভাগে ভোট দেয়ার জন্য কাউকেই চাপ দেয়া চলে না৷’’
আবার রাজ্যে এমন ভোটগ্রহণ কেন্দ্রও আছে, যেখানে ভোটারদের ভোট দিতে যেতে ৩০ মাইল পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়৷ এমন বুথের সংখ্যা ৫১৮৷ এই হেঁটে পাহাড়ি পথ বেয়ে সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য বেশ কয়েকজন ‘রানার'কে ভাড়া করেছে নির্বাচন কমিশন৷ বলে রাখা ভালো, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের সেই মোঘল আমল থেকেই ভারতে হাঁটা পথের সংবাদ বাহকের চল আছে৷
ভারতদাসের জন্য
গুজরাটের সোমনাথ জেলার গির অভয়ারণ্য সিংহের জন্য বিখ্যাত৷ সেই গভীর জঙ্গলে একা বাস করেন এক সাধু৷ তাঁর নাম ভারতদাস দর্শনদাস৷ তাঁর জন্যও ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট নিয়ে গভীর জঙ্গলের উদ্দেশে রওনা হবেন জনা দশেক ভোটকর্মী৷ সেখানে ভোটগ্রহণ হবে ২৩ এপ্রিল৷
গির সোমনাথের ডেপুটি জেলা নির্বাচন অফিসার ভি এম প্রজাপতি জানান, ‘‘রাজ্যের উনা জেলার বানেজ এলাকার একমাত্র ভোটার ভারতদাস৷ কারও ভোট যেন বাদ না পড়ে, সেই লক্ষ্যে তাঁর ভোটগ্রহণ করতে তাঁর কাছে পৌঁছবেন ভোটকর্মীরা৷ অতীতেও একইভাবে তাঁর ভোটগ্রহণ করা হয়েছে৷ প্রতিবারই তিনি ভোট দেন৷’’
নির্বাচনি বন্দোবস্তের এমন হাজারো অভিজ্ঞতার সাক্ষী থেকেছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক দেবাশিস সেন। বর্তমানে তিনি রাজ্যের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব হিসেবে কর্মরত। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানালেন, ‘‘সারা ভারতে নির্বাচন হচ্ছে। প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে রয়েছে। এবার ‘নো ভোটার টু বি লেফ্ট বিহাইন্ড’ ক্যাম্পেন চালাচ্ছে। আমার অভিজ্ঞতা আছে অতীতে বর্ধমানে কালনায় বন্যা হয়েছিল। অথচ ভোটগ্রহণ করতে হবে। তাই নৌকায় তৈরি হয়েছিল ভোটগ্রহণ কেন্দ্র।’’
আরও একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনি। তাঁর সময়ে দার্জিলিংয়ের সান্দাকফুতে ফালুটের কাছে একটি বুথে ভোটগ্রহণ করা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আদিম কালের মতো ফ্ল্যাগ উড়িয়ে সিগন্যাল দিয়ে তথ্য আদান-প্রদান করতে হতো। প্রাক্তন এই নির্বাচন আধিকারিকের কথায়, ‘‘ভারতে ৯৩ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট দেন মানুষ। দল বেঁধে মানুষ ভোট দেন। এই জন্যই বুকার বিজয়ী প্রখ্যাত লেখক অরবিন্দ আদিগা তাঁর ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ বইয়ে লিখেছেন, ভারতে তিনটি উৎসব হয়। জ্বরের উৎসব, পুজো পার্বনের উৎসব এবং নির্বাচনের উৎসব।’’