ওষুধের মারাত্মক ফলাফল
২৪ নভেম্বর ২০১২দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ ও অ্যামেরিকার অনেক মানুষ অনিদ্রায় ভুগতেন৷ এই সমস্যার সমাধানের জন্য আবির্ভাব ঘটে একটি ওষুধের, যার নাম থালিডোমাইড৷ অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ওষুধটি৷ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এটা পাওয়া যেত বলে অনেকেই সহজেই কিনে নিতেন এটি৷ প্রায় ব্যথার ওষুধ অ্যাসপিরিনের মতোই বিক্রি হতে থাকে ওষুধটি৷
অস্ট্রেলিয়ান প্রসূতিবিদ ড. উইলিয়াম মাকব্রাইড পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ধারণা করেন, গর্ভবতী নারীদের অস্বস্তি দূর করার ক্ষেত্রে থালিডোমাইড কাজে লাগতে পারে৷ এরপর থেকে বিশ্বব্যাপী গর্ভবতী মায়েদের বমিবমি ভাব, অনিদ্রা ও ব্যথা দূর করার জন্য ওষুধটি ব্যবহৃত হতে থাকে৷
বাজারে বের হয় কন্টারগান নামে
জার্মান ওষুধ কোম্পানি গ্র্যুনেনথাল ১৯৫৭ সালে কন্টারগান নামে এটিকে বাজারে ছাড়ে৷ প্রথম কয়েক বছর প্রেসক্রিপশন ছাড়াই এই ওষুধটি পাওয়া যেত৷ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এটির এক ভয়ানক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল৷ যে সব গর্ভবতী মহিলা এই ওষুধ নিয়েছিলেন, তাদের বাচ্চারা ফকোমেলিয়া নামে এক বিকাশবিকৃতিজনিত রোগ নিয়ে জন্ম নেয়৷ এই রোগ হলে হাত-পাগুলো অস্বাভাবিক রকমের ছোট হয় এবং আঙ্গুল, কান ও অন্ত্রের বিকাশও হয় অস্বাভাবিক৷ ফকোমেলিয়া বংশগত কারণে কিংবা বাহ্যিক কোনো কিছুর প্রভাবে, যেমন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও হতে পারে৷
এই ধরনের ঘটনার কথা জানা সত্ত্বেও কোম্পানিটি ওষুধ বিক্রি চালিয়ে যায়৷ ফলে হাজার হাজার গর্ভবতী নারী এই ওষুধ সেবন করে বিকলাঙ্গ বাচ্চার জন্ম দেন৷ কেউ কেউ গর্ভপাতও করান৷ অবশেষে ১৯৬১ সালের ২৭ নভেম্বর এই ওষুধকে বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়৷
এ সম্পর্কে দুই মহিলার কথোপকথন
‘‘ঐ নারীরা ছিলেন গর্ভবতী৷ মাথাব্যথার জন্য ব্যথা নিরোধক ওষুধ খেয়ে অঘটন ঘটে৷ ভূমিষ্ট হয় প্রতিবন্ধী বাচ্চারা৷ কী সাংঘাতিক৷''
‘‘এই ঘটনা আমাকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছে৷''
অনেকের স্মৃতিতে জাগরুক
অনেকেই জার্মানির এই ওষুধ কেলেঙ্কারির কথা স্মরণ করতে পারেন৷ শুধু জার্মানিতে নয় বিশ্বের অন্যান্য দেশেও হাজার হাজার মেয়ে কন্টারগানের শিকার হয়ে প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দিয়েছেন৷ সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ১০ হাজারের মতো হবে৷ জার্মানিতে ক্ষতিগ্রস্তরা গ্র্যুনেনথাল কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন৷ অবশেষে কোম্পানিটি ১৯৭০ সালে একটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কিছু ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়৷ পরে সরকারও এই ফাউন্ডেশনে ১৬০ মিলিয়ন ইউরো সহায়তা হিসাবে দেয়৷ আজ একজন কন্টারগানের শিকার ব্যক্তি মাসে ১১০০ ইউরোর মতো ভাতা পান৷ এই অর্থ নিতান্তই নগন্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা৷
ইউনিভার্সিটি হাইডেলব্যার্গের বার্ধক্যবিদ্যা ইন্সটিটিউটের এক রিপোর্টে জানা গেছে, ভুক্তভোগী এইসব মানুষেরা সব দিক দিয়েই অত্যন্ত দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন৷
হাত পায়ের বিকাশ না হওয়ায় নানারকম শারীরিক অসুবিধা তো আছেই, তার ওপর কয়েক দশক ধরে শরীরে একপেশে চাপের কারণে মেরুদণ্ড, অস্থিসন্ধি, পেশি ইত্যাদিতেও সমস্যা দেখা দেয়৷ এজন্য তাদের সেবাযত্নের প্রয়োজনও অনেক বেশি৷ জার্মানির কন্টারগান সংঘের মুখপাত্র ইলোনকা স্টেব্রিজ, যিনি নিজেও কন্টারগান-এর একজন শিকার, জানান, ‘‘ভেবে দেখুন, যার কোনো হাত নেই, পা দিয়ে খাওয়া দাওয়া ও লেখালেখি করতে হয় তাকে৷ তার যদি হাঁটু বা নিতম্বের জোড়ায় ব্যথা হয়, তা হলে দৈনন্দিন সাধারণ কাজকর্ম সম্পন্ন করাও সম্ভব হয়না তার পক্ষে৷ দাঁত দিয়ে আমরা অনেক কাজকর্ম করে থাকি৷ যেমন দাঁত দিয়ে আমি বোতলের মুখ খুলতে পারি, জানালার খড়খড়িও ওপরে তুলতে পারি৷''
দিনদিন অসহনীয় হচ্ছে
কন্টারগানের শিকার মানুষদের জীবন কাটানোটা দিন দিন দুঃসহ হয়ে উঠছে৷ অর্থের অভাবে থেরাপি, সেবাশুশূষা, দৈনন্দিন কাজে সহায়তা ইত্যাদির ক্ষেত্রে তারা নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন৷ শুধু তাই নয়, ভুক্তভোগী মানুষগুলির জন্য সাহায্যের হাত আরো গুটিয়ে নিতে চাইছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলি৷ বলা হচ্ছে আত্মীয়স্বজন, যেমন মা-বাবা কিংবা সন্তানদের এই দায়িত্বভার নিতে হবে৷
ব্রিটেনে কন্টারগান দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যক্তি গত দশ বছর ধরে প্রতি বছর প্রায় ৬২০০০ ইউরো আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন৷ কিন্তু জার্মানিতে এই সংখ্যাটা ছিল মাত্র ছয় হাজার ইউরো৷ ইলোনকা শ্টেব্রিজ আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘কন্টারগানের শিকার মানুষদের সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে যে গবেষণা প্রকল্প চালানো হয়েছিল, তা থেকে একটা ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে এবং সরকার তার কথা রাখবে৷ এই গবেষণায় ৯০০ জন ভুক্তভোগীও অংশ গ্রহণ করেছিলেন৷''
উল্লেখ্য থালিডোমাইড আবার বাজারে আসার ছাড়পত্র পেয়েছে৷ যদিও অত্যন্ত সীমিত আকারে৷ এটি ক্যানসার ও লেপ্রা রোগের চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয় এখন৷ ল্যাটিন অ্যামেরিকায় গর্ভবতী নারীদের লেপ্রার চিকিৎসায় এই ওষুধ ব্যবহার করে বিকলাঙ্গ বাচ্চার জন্মের খবর পাওয়া গেছে৷