একদল নারী, অস্ত্র তাদের কাগজ আর কলম
৩১ জুলাই ২০১০ভারতের বুন্দেলখন্ড অঞ্চলের চিত্রকূটের একটি অস্থায়ী বাড়ি৷ ‘খবর লাহারিয়া' পত্রিকার কার্যালয়ে মঙ্গলবারের এক সকাল৷ বৈঠক করছেন পত্রিকাটির সম্পাদকীয় কর্মীরা৷ কোন কম্পিউটার নেই, নেই কোন টেবিল৷ ১৬ জন নারীর সবাই গোল হয়ে মাটিতে বসেছেন৷ তাদের চারপাশে খবরের কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ মীরা পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক৷ তিনি বলেন, ‘‘মানুষ মনে করে, সাংবাদিকতা শুধু পুরুষের কাজ৷ তারা আরও ভাবে, নারীরা কেন তা করছে? কিন্তু আমরা মনে করি, নারীদেরও সাংবাদিকতা করা উচিত এবং গত ৮ বছর ধরে আমরা সেটাই প্রমাণ করেছি৷ আমরা প্রচেষ্টা দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছি নারীরাও যথেষ্ট শক্ত৷''
বুন্দেলখন্ড অঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি নারী কখনও বিদ্যালয়ে যাবার সুযোগ পাননি৷ শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি নারী এবং শতকরা ৩০ ভাগ পুরুষ পড়ালেখা জানেন না৷ শিক্ষার অভাব এবং অশিক্ষার উচ্চ মাত্রা ঐ অঞ্চলে সৃষ্টি করেছে এক দুষ্ট চক্র৷ এই দুষ্টচক্র ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একদল নারী৷ আর তাদের অস্ত্র কাগজ, কলম৷ হ্যাঁ তারাই ‘খবর লাহারিয়া' পত্রিকার সৈনিক৷ ‘খবর লাহারিয়া' শব্দের বাংলা করলে দাঁড়ায় খবর তরঙ্গ৷
৮ পাতার একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘খবর লাহারিয়া'৷ পত্রিকাটি সম্পূর্ণভাবে নারীদের দ্বারা পরিচালিত৷ প্রতিবেদন সংগ্রহ, সম্পাদনা এবং ছাপা থেকে শুরু করে বিতরণ পর্যন্ত সব কিছুই করছেন নারীরা৷
২২ বছর বয়সী আনারকলি এক বছর ধরে ‘খবর লাহারিয়া'র প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করছেন৷ দশ মাস বয়সের একটি বাচ্চা আছে তার৷ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার জন্যে প্রতিদিনই পরিবারের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে তাকে৷ আনারকলি বলেন, ‘‘আমার পরিবার বলছে, তুমি একজন নারী, তোমার এই কাজ করা উচিত নয়৷ তুমি যদি কাজ করতে বাইরে যাও, তাহলে বাড়ির কাজ করবে কে? আমি বলি, বাড়ির কাজ আগে করে তারপরেই আমি বাইরে যাবো৷ আর তারপরেও যদি সমস্যা হয়, তাহলে আমি আমার সন্তানটিকে সঙ্গে নিয়ে যাবো৷ তাহলে আর সমস্যা কোথায়?''
আসলে ভারতীয় এনজিও ‘নিরন্তর'এর পরিকল্পনাতেই ‘খবর লাহারিয়া' প্রকাশ করা শুরু হয় ২০০২ সাল থেকে৷ আগে থেকে পুরুষের দখল করে রাখা পেশার এই ক্ষেত্রটিতে ভারতের গ্রামীণ নারীদের প্রবেশের সুযোগ করে দেয়াই ছিল তাদের লক্ষ্য৷ আর সম্পূর্ণভাবে নারী নিয়ন্ত্রিত সম্পাদকীয় এই দলটি স্বাভাবিকভাবেই নারীদের ইস্যুকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন৷
‘খবর লাহারিয়া'র হয়ে কাজ করার জন্যে ২০০৯ সালে ‘ইউনেস্কো লিটারেসি প্রাইজ' পুরস্কার দেয়া হয় নিরন্তরকে৷ পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক মীরার মতে, বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্যে তাদের পত্রিকাতে খুব সাধারণভাবে লেখা হয়৷ মীরা বলেন, ‘‘আমরা বড় ফন্ট ব্যবহার করি, কেননা যারা নতুন লেখাপড়া শিখছে, তারা এবং যারা কম শিক্ষিত তারাও তাহলে পত্রিকাটি পড়তে পারবে সহজেই৷ বুন্দেলখন্ডের খুব কম মানুষই নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ার সুযোগ পান৷ আর আমরা পত্রিকা পড়ার জন্যে নারীদের উৎসাহিত করছি৷''
তবে ‘খবর লাহারিয়া' পত্রিকাটির প্রধান সমস্যা, পত্রিকাটির প্রচার বা এর কাটতি৷ সম্পাদকীয় দলের সদস্যরাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই পত্রিকার বিক্রির দায়িত্ব পালন করেন৷ সিনিয়র সম্পাদক শান্তি পত্রিকাটির সর্বশেষ সংস্করণ নিয়ে মানিকপুরের একটি গ্রামে যান৷ অঞ্চলটি পত্রিকাটির সদর দপ্তর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে৷ শান্তি বলেন, ‘‘সবাই যখন পত্রিকায় দেখে, একটি ট্রাকে আগুন লেগেছে এবং আমরা সেটি পত্রিকায় দিয়েছি, তখন তারা সত্যিই চিন্তিত হয়ে যায়৷ জিজ্ঞাসা করে, কেন আমি শিক্ষকতার কাজ করছি না? এই কাজ করতে গিয়ে আমার যদি কিছু হয়েও যায়, তাহলেও অন্তত মানুষ তো তা জানতে পারবে৷''
প্রতিবেদন: ফাহমিদা সুলতানা
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন