একমাত্র ঘুমের সময় ছুটি
২৪ এপ্রিল ২০১৪শুধু ফুটবল বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম তৈরি করতে গিয়েই যে বিদেশি শ্রমিকরা কাতারে অমানবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, এমনকি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান, এমন নয়৷ কাতারে অন্যান্য বিদেশি শ্রমিকরাও নিয়মিতভাবে অত্যাচার ও নিপীড়নের সম্মুখীন হচ্ছেন, যেমন গৃহকর্মীরা, যাঁদের নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মানবাধিকার সংগঠন এবার একটি বিবরণ প্রকাশ করেছে৷
অ্যামনেস্টির হয়ে যাঁরা তাঁদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, সংশ্লিষ্ট গৃহকর্মীরা তাঁদের যে সব কাহিনি শোনান, তা চমকে ওঠার মতো: অত্যন্ত কম মাইনে; সপ্তাহে ১০০ ঘণ্টা কাজ; বিরতি কিংবা ছুটির দিন নেই বললেই চলে; ঘুমের সময় কম; মালিক বা মালকিনের হাতে অত্যাচার-অপমান৷ কাতারে ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি বিদেশি ঘর পরিষ্কার করা, রান্না, বাচ্চাদের দেখাশোনা, ড্রাইভার কিংবা মালির কাজে নিযুক্ত৷ এঁদের মধ্যে মহিলাদেরই সংখ্যা বেশি: ৮৪ হাজার৷ মালিকরা কাতারি, ইউরোপীয়, মার্কিনি অথবা এশিয়া কি আফ্রিকার কোনো দেশের মানুষ৷ অপরদিকে ‘কাজের লোকেরা' আসেন প্রধানত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে৷
মালিক যেখানে ‘মা-বাপ'
‘একমাত্র ঘুমের সময়টাই আমার ছুটি' – এই শিরনাম দিয়ে অ্যামনেস্টি যে রিপোর্টটা প্রকাশ করেছে, তার জন্য ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৩ সালের মার্চের মধ্যে ৫২ জন ‘কাজের বুয়ার' সঙ্গে কথা বলা হয়েছে৷ এঁরা সবাই কাতারে কাজ করেন৷ এছাড়া অ্যামনেস্টি স্বরাষ্ট্র এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ে খোঁজখবর করেছে; যে সব দেশ থেকে গৃহকর্মীরা এসেছেন, সেই সব দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে৷
মহিলারা শুনিয়েছেন, তাঁদের কিভাবে মারধোর করা হয়, চুল ধরে টানা হয়, সিঁড়ি দিয়ে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়৷ ইন্দোনেশিয়ার এক মহিলার গায়ে ছুরি দিয়ে কাটার দাগ ছিল; তাঁর বুকে গরম ইস্তিরি দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়, তার দাগ ছিল৷ তিনজন মহিলা জানিয়েছেন, তাঁদের ধর্ষণ করা হয়েছে৷ খুব কম ক্ষেত্রেই এই ধরনের ধর্ষণের কথা পুলিশকে জানানো হয় অথবা অভিযোগ দায়ের করা হয়, কেননা মহিলাদের হয়ত উল্টো শুনতে হতে পারে যে, তাঁরাই প্ররোচনামূলক আচরণ করেছেন৷
৫২ জন গৃহকর্মী: সংখ্যাটা খুব বেশি না হতে পারে; তবুও মহিলাদের বক্তব্যে তাঁদের রূঢ় বাস্তবের একটা ছবি ফুটে উঠেছে, বলে অ্যামনেস্টির ধারণা৷ অ্যামনেস্টির যে প্রতিনিধি কাতারের পরিস্থিতির উপর নজর রাখেন, তিনি হলেন রেজিনা স্পোয়টল৷ কাতারে যে সব বিদেশি মহিলারা গৃহকর্মীর কাজ করেন, তাঁদের প্রায় অর্ধেককে কর্মজীবনে কোনো না কোনো যৌন অপব্যবহারের শিকার হতে হয়, বলে রেজিনার ধারণা৷ তার একটা প্রমাণ, প্রতি সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলিতে এই সব গৃহকর্মীদের তরফ থেকে ডজন-ডজন অভিযোগ আসে৷ গতবছর কাতারের মানুষ-পাচার প্রতিরোধ নিধির কাছে মাসে ২০০ থেকে ৩০০ অভিযোগ এসেছে টেলিফোনের মাধ্যমে৷
অজানাকে ভয় কি আমার ওরে?
একে তো যে এজেন্সিগুলি এই সব গৃহকর্মীদের চাকুরির প্রলোভন দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আনে, তারা এখানকার বাস্তব পরিস্থিতির কথাটা উহ্যই রাখে৷ তার ওপর আবার সহজ সরল মানুষেরা আর্বি ভাষায় লেখা চুক্তি পড়তেই পারেন না৷ কাতারে পা দিলেই তাঁরা পড়েন তথাকথিত ‘‘স্পন্সর আইনের'' আওতায়৷ স্পন্সর বলতে বোঝায় এক ধরনের গ্যারান্টর, যিনি অধিকাংশ অভিবাসীর ক্ষেত্রে স্বভাবতই মালিক নিজে৷ স্পন্সর আইনের কল্যাণে গৃহকর্মীরা গৃহকর্তার মেজাজ-মর্জির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল৷ স্পন্সরের অনুমতি ছাড়া গৃহকর্মীরা চাকরিও বদলাতে পারেন না, দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারেন না৷ করলে আবার সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ! আইনের দিক দিয়েও গৃহকর্মীদের অবস্থান দুর্বল: কাতারের শ্রম আইনে ছুটির দিন থেকে শুরু করে কমপ্লেন করার ব্যবস্থা, সবই আছে; কিন্তু গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়৷
কাতার ও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশে বিদেশি কর্মীদের অবস্থা সম্পর্কে ইতিপূর্বেও জানাজানি ও লেখালিখি হয়েছে৷ কিন্তু দৃশ্যত কাতার সরকারের উপর চাপ এখনও পর্যাপ্তভাবে বৃদ্ধি পায়নি৷