‘একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি জরুরি'
২৫ মার্চ ২০১৯দু'বছর পর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ৷ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার, আল বদরদের সঙ্গে মিলে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালিয়েছে৷ কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি৷
বরং বাংলাদেশের একটি ট্রাইব্যুনালে স্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পর এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে এর স্বচ্ছতা ও মানদণ্ড নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়েছে৷ এমনকি গণহত্যায় কত মানুষ শহিদ হয়েছেন তার সংখ্যা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে দেশি ও আন্তর্জাতিক মহলে৷
নানাভাবে ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক সত্যগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা গত পাঁচ দশক ধরে চলেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷
নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে ‘ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম' আয়োজিত এক সাম্প্রতিক সেমিনারে শহিদ পরিবারর সদস্য, গবেষক, সাংবাদিক ও কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা হয় ডয়চে ভেলের৷
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে, তাতে কোনো সংশয় নেই বলে মনে করেন জার্মানির হাইডেলব্যার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. ভল্ফগাঙ পেটার সিঙ্গেল৷ ‘‘আমার মনে হয় না, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো ঘাটতি আছে৷ সমস্যা হচ্ছে, বাংলাদেশ যেটি পাচ্ছে না তা হলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷
ভল্ফগাঙ আরো বলেন যে, বাংলাদেশের গণহত্যা সর্বজনস্বীকৃত৷ ‘‘আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় যান, বা গুগলে যান এবং সেখানে গিয়ে লিখুন বাংলাদেশ জেনোসাইড অথবা শুধু জেনোসাইড৷ তখন আপনি দেখবেন যে, এখানকার গণহত্যা স্বীকৃত৷ যেসব গণহত্যার নাম আসবে সেখানে দেখবেন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশে গণহত্যা তার অন্যতম,'' বলেন তিনি৷
কিন্তু কেন মিলছে না আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি? এর জন্য অনেকেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যথাযথ তৎপরতার অভাবকে দায়ী করেন৷ আর ভল্ফগাঙ-এর মতে, ৫০ বছর পর এই স্বীকৃতি পাওয়া কঠিন হবে৷ ‘‘আপনি কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন এবং এর প্রতিকার চাইতে পারেন৷ কিন্তু ৫০ বছর পর এই স্বীকৃতি কঠিন হবে,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷ যোগ করেন, ‘‘আরেকটি বিষয় হতে পারে আপনি বিষয়টি সাধারণের চেতনায় আনতে পারেন৷ শুধু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নয়, যে দেশ এই অপরাধ করেছে, সেদেশের মানুষের চেতনায়, এক্ষেত্রে পাকিস্তান৷''
সংখ্যার রাজনীতি
মুক্তিযুদ্ধে কতজন শহিদ হলেন, কতজন মা-বোনের সম্ভ্রমহানি হলো, সেই সংখ্যা নিয়ে আজও ভিন্নমত পাওয়া যায়৷ এ নিয়ে রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের ভেতরেও দ্বিধাবিভক্তি কাজ করে৷ এই সংখ্যার খেলাকে একটি গণহত্যার ভয়াবহতা কমিয়ে দেখানোর রাজনীতি বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক৷
এ বিষয়ে ‘বাংলাদেশের বন্ধু' খেতাবপ্রাপ্ত ব্রিটিশ রাজনীতি বিশ্লেষক ও সাংবাদিক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংখ্যার এই রাজনীতি বরাবর ছিলই৷ অনেক মার্কিন লবিস্টও চেষ্টা করেছেন সংখ্যা কমিয়ে দেখাতে৷''
একাত্তরে শহিদ বুদ্ধিজীবী ও লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারের কন্যা শমী কায়সার বলেন, এই অস্বীকারের রাজনীতি আসলে জামায়াতের৷
‘‘জামায়াতে ইসলামের রাজনীতি হলো অস্বীকার করা,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷ ‘‘তারা অস্বীকার করে আসছে যে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে৷ আমরা শহিদ পরিবার ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে কাজ করছি যেন একটা জেনোসাইড ডিনায়াল অ্যাক্ট করা হয়৷''
হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ভল্ফগাঙও মনে করেন যে, বিশেষ করে গণহত্যার মতো অপরাধের পর এ নিয়ে যেভাবে ‘অস্বীকার' করার রাজনীতি শুরু হয় তা খুবই অনাকাঙ্খিত৷
‘‘গণহত্যার সবচেয়ে করুণ পরিণতি হলো, যখন একে অস্বীকার করা হয়, এটা কাম্য নয়,'' বলেন তিনি৷
বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি নিয়ে গেল ক'বছর ধরে কাজ করছেন নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মোঃ বেলাল৷ ‘‘সংখ্যার রাজনীতি এখনো আছে৷ এটা আমি অস্বীকার করতে পারব না৷ আমাদের দেশে এখনো অনেক মানুষ আছে, যারা এই গণহত্যার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী৷ কিন্তু ‘সরি' এই কথাটি বলার মতো সৎসাহস তাদের নেই,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷
‘‘যারা নাম্বার্স গেম খেলে তাদের আমি বলব, ওদের জায়গা থেকে বিবেচনা করে দেখুন যে বেদনাটুকু কত বড়৷ আমি সবসময় মনে করি, ওয়ান ডেথ ইজ টু মেনি৷ সে দৃষ্টিকোণ থেকে বলব আর কত হলে এটাকে আপনি গণহত্যা বলবেন? বাংলাদেশের আনাচে কানাচে আপনারা কি দেখেন না? সে কষ্ট যদি আত্মস্থ করতে পারি, তাহলে নাম্বার বা সংখ্যা অত্যন্ত গৌণ৷ সত্যিকার অর্থে আমি বলতে পারি যে, যে নাম্বারটা বলা হচ্ছে তাও হয়তো যথেষ্ট নয়,'' বলেন বেলাল৷
মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিতর্ক
বাংলাদেশের আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকায় তা নিয়ে ববাবরই আপত্তি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো৷ বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রসঙ্গে এই বিতর্ক বারবার ওঠানো হয়েছে৷
ব্রিটিশ রাজনীতি বিশ্লেষক ও সাংবাদিক ক্রিস ব্ল্যাকবার্নের মতে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবার ক্ষেত্রে এটি একটি বাধা৷ ‘‘আমার মনে হয়, সবাই জানেন যে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল৷ পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস থেকে শুরু করে অনেক মার্কিন টিভি এটা কাভার করেছে৷ তবে আমি মনে করি যে কারণে বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পায়নি তা হলো মৃত্যুদণ্ডের বিধান৷''
তবে তিনি মনে করেন, এই বিধান ‘কনটেক্সটচুয়াল' বা ঘটনাপ্রাসঙ্গিক৷ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন শহিদ পরিবারের সদস্য শমী কায়সার৷ ‘‘ডেথ পেনাল্টি হলো কনটেক্সটচুয়াল৷ আমি এর পক্ষে৷ যারা একজন নয়, দু'জন নয় লাখো মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের ক্ষেত্রে কেন এটা প্রযোজ্য হবে না? তারা কেন যথাযথ বিচারের মুখোমুখি হবে না?''
প্রতিশোধ নয়, বিচার
বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে একটি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা পূরণ করেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ বাংলাদেশের গণহত্যার বিচার শুধু বাংলাদেশিদের জন্য নয়, বরং পৃথিবীতে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখা যায়, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য এর স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক বিচার প্রয়োজন বলে মনে করেন তাঁরা৷
নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মোঃ বেলাল বলেন, ‘‘আমাদের প্রথমত দেখতে হবে নৈতিকতার দিক থেকে৷ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে৷ মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে৷ বাংলাদেশ সরকার প্রথমে যে কাজটি করা দরকার ছিল, সে কাজটিই করেছে৷ সেটি হলো, বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিচারের সংস্কৃতি চালু করা৷''
‘ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম' এই স্বীকৃতির বিষয়টি ইউরোপের নীতিনির্ধারকদের কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে৷ সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট আনসার আহমেদ উল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা চাচ্ছি, ইউরোপের বাঙালিদের নিয়ে আমরা ইউরোপীয় পলিসিমেকারদের সঙ্গে বসব৷ বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছিল সেটা নিয়ে আমরা তাদের জানাব,'' বলেন তিনি৷ ‘‘কারণ, বাংলাদেশের গণহত্যা যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়, তাহলে ২০১০ সালে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, সে বিচারে কেবল স্থানীয়ভাবে যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার হয়েছে, যারা মূল পরিকল্পনাকারী ও হত্যাকারী সেই পাকিস্তানিদের আমরা বিচারের আওতায় আনতে পারব৷ এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন দরকার৷''
তবে কোনো প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে এই বিচার চাইছেন না বলে জানান তিনি৷ ‘‘বিচার কিন্তু প্রতিশোধ থেকে নয়, বিচার চাওয়া হচ্ছে যেন আগামীতে এ ধরনের অন্যায় না হয় এবং এটা কালচার অফ ইমপিউনিটি বন্ধ করার জন্য৷ কারণ একটা লোক যদি অন্যায় করে পার পেয়ে যায় তখন সেটা এনকারেজ করে আরো অন্যায়ের জন্য,'' বলেন আনসার৷
শমী কায়সার বলেন, ‘‘পাকিস্তানের জন্য এখনই উপযুক্ত সময় বাংলাদেশে যেসব পরিবার তাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া এবং বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া৷ যদি তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক, পেশাদার সম্পর্ক চায় তাহলে তাদের এটা করা উচিত৷''
পাকিস্তানে ১৯৭১-এর বিষয়ে সচেতনতা তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন অধ্যাপক ভল্ফগাঙ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সমস্যা হলো, পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম এই বিষয়ে প্রায় কিছুই জানেন না৷ যতটুকু জানে, তা ভুল এবং তাদের ইতিহাসের বইয়ে যেভাবে লেখা হয়েছে৷''
হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক যোগ করেন, ‘‘তাহলে যেটা প্রয়োজন তা হলো, একটি আলোচনা শুরু করা, যে আলোচনায়, পাকিস্তানের ইতিহাসবিদরা থাকবেন এবং আন্তর্জাতিক ইতিহাসবিদরা থাকতে পারেন, যেমন জার্মানি ও ফ্রান্স বা জার্মানি ও পোল্যান্ডের ইতিহাসবিদদের জয়েন্ট কমিশন আছে৷ তারা ঠিক করবেন ইতিহাস কীভাবে লেখা হবে৷ এখন হয়তো এটা কিছুটা অসম্ভব মনে হচ্ছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে ভালোর জন্য এটাই দরকার৷''
এ বিষয়ে আপনার মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷