1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

একের পর এক জামিন, তদন্ত তবে কোন পথে?

২৮ নভেম্বর ২০২৪

তদন্ত বিশ বাঁও জলে। অথচ একের পর এক অভিযুক্তের মিলছে জামিন। বিভিন্ন মামলায় ইডি বা সিবিআইয়ের তদন্ত কোথায় দাঁড়িয়ে, তা স্পষ্ট নয়।

https://p.dw.com/p/4nVfC
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা
জামিনে মুক্ত অর্পিতাছবি: Satyajit Shaw/DW

নিয়োগ দুর্নীতি হোক বা গরু পাচার মামলা, এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কম সরগরম হয়নি। আদালতের নির্দেশে একের পর এক মামলায় তদন্তভার হাতে নিয়েছে একাধিক কেন্দ্রীয় সংস্থা। কিন্তু সারদা বা নারদ মামলার মতো এই তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। শেষ পর্যন্ত কি আদৌ অপরাধের উপর পর্দা সরবে? প্রশ্ন সব মহলের।

একাধিক মামলায় জামিন

শিক্ষা নিয়োগ দুর্নীতির অন্যতম অভিযুক্ত সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তার ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয় জন জামিনে মুক্ত হয়েছেন এই মামলায়। সিবিআই ও ইডি এই মামলার তদন্ত চালাচ্ছে। প্রায় দু'বছর চার মাস পর জেল থেকে মুক্তি পেলেন তিনি। মায়ের মৃত্যুর কারণে তিনি এর আগে প্যারোলে সাময়িক মুক্তি পেয়েছিলেন। প্যারোলে থাকাকালীনই তার জামিন হয়।

অন্যদিকে, গরু পাচার মামলায় জামিন পেয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল ও তার কন্যা সুকন্যা মণ্ডল। তিহার জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অনুব্রত কালীঘাটের তৃণমূলের বৈঠকে বীরভূমের রাশ আবার নিজের হাতে নিয়েছেন।

প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডির মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও ইডির মামলায় ছাড়া পেলেও সিবিআই নিজেদের হেফাজতে রেখে দিয়েছে এদের দুজনকে।

পুজোর আগে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য, মানিকের স্ত্রী-ছেলে, বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা।

অন্যদিকে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জামিন রোখার জন্য এবার নতুন নতুন তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে নেমেছে সিবিআই। এর জন্যই পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ প্রোমোটার সন্তু গঙ্গোপাধ্যায়কে সোমবার গ্রেফতার করেছে তারা। প্রশ্ন উঠছে, এতজন অভিযুক্তের জামিনের পর সাধারণ মানুষকে ভরসা করতে পারবেন তদন্তের উপর?

বিভিন্ন মহলে প্রতিক্রিয়া

বিজেপি নেতা বিমলশঙ্কর নন্দ ডিডাব্লিউকে বলেন, "প্রথমত এই তদন্তগুলো আদালত মনিটর করছে। এখানে রাজনৈতিক দল বা সরকারের কোন ভূমিকা নেই। আদালতের নির্দেশে তদন্ত হচ্ছে, তাই কোন গতিতে তদন্ত এগোচ্ছে সেটা আদালতেরই দেখার কথা। দ্বিতীয়ত, যদি দেখা যায় যে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আর তদন্তকে কোনোভাবে প্রভাবিত করতে পারবেন না, তখনই তারা জামিন পান। তাই সিবিআই কিছু করছে না এটা বলা যায় না। জনতার সামনে সিবিআই তদন্ত করে না। বিষয়গুলো তারা আদালতকে জানায়।"

পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জামিনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "যে ব্যক্তি প্রভাবশালী, বাইরে বেরোলে তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারেন, সেই ব্যক্তির জামিন সাধারণভাবে চায় না তদন্তকারী সংস্থা। আদালতে গিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে হয়তো তাই আটকানো হচ্ছে। বাকিদের ক্ষেত্রে তদন্তের অংশটা শেষ হয়ে গিয়েছে, তাই তারা জামিন পেয়েছেন।"

তৃণমূল মুখপাত্র তথা আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কাউকে বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখা যায় না। জামিন পাওয়াটাই স্বাভাবিক, জামিন না পাওয়াটা অস্বাভাবিক। এতদিন কাস্টডিতে থাকার পরে তদন্তকারী সংস্থা যদি চার্জশিট জমা দিতে না পারে, তাহলে যারা কাস্টডিতে আছেন তারা জামিন পেয়েই যাবেন। যার ফলে মণীশ শিশোদিয়া, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, হেমন্ত সোরেন জামিন পেয়েছেন। একজন দুই আড়াই বছর জেলে রয়েছে তাও ট্রায়াল শুরু করা গেল না! তদন্তের অগ্রগতি না হলে অভিযুক্ত জামিন কেন পাবেন না? সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় মানুষের স্বাধীনতার অধিকার বলা হয়েছে।"

দুই দলের মধ্যে তলায় তলায় আঁতাত আছে: শুভময় মৈত্র

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমাদের দেশের আইনি এবং পুলিশি ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা আছে। আমাদের দেশে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা কম ও বিষয়গুলি খুবই জটিল, তাই দীর্ঘসূত্রতা হয়। আমাদের দেশ একটা গণতান্ত্রিক দেশ, এখানে যখন তখন কাউকে অপরাধী বলে শাস্তি দেওয়া যায় না। আইনি ব্যবস্থার সেই দিক থেকে শাস্তি পাওয়া বা না পাওয়া অনেকটা সময়সাপেক্ষ। তাই জামিন পাওয়াও খুব স্বাভাবিক। আবার রাজনৈতিকভাবে দেখতে গেলে বিজেপি তৃণমূলকে বিব্রত করতে চায় না। সেখান থেকেই বিরোধীদলগুলি অর্থাৎ বাম-কংগ্রেস সেটিং তত্ত্বের কথা আনছে।

অর্থাৎ দুই দলের মধ্যে তলায় তলায় আঁতাত আছে। সেটিং তত্ত্বটাও যে একেবারে নেই সেটাও বাইরে থেকে বলা যাবে না। সেই কারণে তদন্তের গতি ঠিকভাবে এগোচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে।"

সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "পশ্চিমবাংলায় দুর্নীতি যে রমরমা সে নিয়ে সন্দেহ নেই। সিবিআই তদন্ত যে গতি পাচ্ছে না, এটাতে তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের ভরসা কমছে। অর্থাৎ আইন বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের ভরসা কমছে। চোখের সামনে যাদের টাকা নিতে দেখেছে, নারদা মামলায় তাদেরও এখনো কিছু হলো না। যার বাড়ি থেকে ৫০ কোটি টাকা উদ্ধার হল, সেও জামিন পেয়ে গেল। অনুব্রত, অর্পিতা, মানিক, জীবনকৃষ্ণ যেভাবে জামিন পেয়ে যাচ্ছেন, তাতে মানুষ বুঝতে পারছে, যেভাবে তদন্ত হওয়া উচিত, সেটা হচ্ছে না। বিচার ব্যবস্থার উপর মানুষের ভরসা কমছে। এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে সিবিআইয়েরমাস্টারমাইন্ড কোন না কোনও ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, মমতা ব্যানার্জি ও তার বাহিনীকে কোনোভাবেই ডিস্টার্ব করা যেন না হয়। এতে তদন্তের গতি এবং তদন্তের সত্যতা সম্পর্কে মানুষ অস্বস্তিতে আছে। অপরাধের গোড়া চিহ্নিত করে তদন্ত এগোচ্ছে না।"

সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "সাধারণভাবে আমাদের দেশে ধনী, রাজনৈতিক মদতপুষ্ট অপরাধীদের শাস্তি শেষ পর্যন্ত কম হয়। তারা বিচার ব্যবস্থার নানারকম সুযোগ-সুবিধা খুব দক্ষতার সঙ্গে গ্রহণ করেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় দোষ প্রমাণ হয় না। তবে জামিন পাওয়াটা নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। যেহেতু আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়, সেহেতু তো আমাদের সন্দেহ হয়, জামিনটাই শেষ পর্যন্ত বিচারের ফল যেন না হয়ে যায়।"

অভিযুক্তর বিরুদ্ধে অপরাধের যে ধারা দেয়া হয়েছে, তাতে সর্বোচ্চ সাজার এক তৃতীয়াংশ কেউ জেলে থাকলে জামিন দিতে হবে। আইনজীবী ফিরদৌস শামীম বিডব্লিউকে বলেন, "চাকরি বিক্রি করে দুর্নীতি করার মত হোয়াইট কালার অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুব একটা কঠোর আইন আমাদের দেশে নেই। এটা সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। দ্বিতীয়ত অনেক মামলায় আদালতের দ্বারা স্থগিতাদেশের জন্য তদন্ত শেষ করতে সময় লাগে।"

তার মতে, "এছাড়া শাসকদলের অভিযুক্ত নেতা ও ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া চালাতে গেলে যে অনুমোদন লাগে, তা রাজ্য সরকার দিচ্ছে না। আবার অভিযুক্তরা আদালতে বলছেন, বিচার প্রক্রিয়ায় যেখানে শুরু হচ্ছে না, তাহলে তাদের দিনের পর দিন জেলে রাখা কেন? তদন্তকারী সংস্থার পক্ষ থেকে যে উদাসীনতা, অনীহা ও দক্ষতার অভাব রয়েছে, তার জন্য এরা জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। তবে জামিন পেয়ে যাওয়া মানেই এরা নির্দোষ হয়ে যাচ্ছেন, এমনটা নয়।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷