এসপিডি-র ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার - নেপথ্য থেকে আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে
১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯রক্ষণশীল খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী শিবিরের পক্ষে বর্তমান চ্যান্সেলার আঙ্গেলা ম্যার্কেল পুনর্নির্বাচিত হতে চান৷ তিনি এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে৷ তাঁকে চ্যালেঞ্জ করতে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন ভাইসচ্যান্সেলার তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সামাজিক গণতন্ত্রী দলের ফ্রাঙ্ক ভালটার স্টাইনমায়ার৷ সামাজিক গণতন্ত্রী দল বা এসপিডির জনপ্রিয়তায় ধস নামছিল ক্রমশই৷ তবে সাম্প্রতিক রাজ্য ও পৌর নির্বাচনের পর এবং ১৩ সেপ্টেম্বরের ম্যার্কেল-স্টাইনমায়ার টিভি ডুয়েলের পর এসপিডি কিছুটা সামাল দিয়ে উঠতে পেরেছে৷ তবুও বলতে হবে কঠিন এক সময়েই হাল ধরতে হচ্ছে ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ারকে৷
‘অনিচ্ছুক এক সুপারম্যান' ২০০৮ সালের জুন মাসে ফ্রাঙ্ক-ভালটার স্টাইনমায়ারকে এই বলে অভিহিত করেছিল ‘ভেল্ট আম জনটাগ পত্রিকা'৷ সেই সময় মনে হয়েছিল চ্যান্সেলর পদে প্রার্থী হতে স্টাইনমায়ার বুঝি খুব একটা আগ্রহী নন৷ কিন্তু তার চার মাস পরেই ৯৫ শতাংশ ভোটে এসপিডির পক্ষ থেকে চ্যান্সেলার পদপ্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত করা হয় ফাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ারকে৷ তাঁর প্রতি দলের সদস্যদের এই আস্থা দৃঢ়তার সাথে গ্রহণ করেন স্টাইনমায়ার৷ দলের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজেকে পরীক্ষা করে দেখেছি এবং খুব হালকাভাবে এই সিদ্ধান্ত নেইনি৷ কিন্তু তোমাদের যদি আমার প্রতি আস্থা থাকে তাহলে আমিও প্রস্তুত৷''
আর এই ভাবেই রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকটা নিভৃতচারী বলে পরিচিত স্টাইনমায়ার জার্মান রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে এসে পড়েন৷
ফ্রাংক-ভাল্টার স্টাইনমায়ারের জন্ম ১৯৫৬ সালের ৫ই জানুয়ারি জার্মানির নর্থরাইন ওয়েস্ট ফালিয়া রাজ্যের ডেটমল্ড শহরে৷ আইন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি গিসেন শহরে৷ পড়াশোনা শেষ করার পর গিসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে গবেষণা সহকারী হিসাবে কাজ করেন৷ প্রভাষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন ভিসবাদেন শহরে৷ ১৯৭৫ সালে যোগ দেন তিনি এসপিডিতে৷ ১৯৯১ সালে লোয়ার স্যাকসনি অঙ্গরাজ্যে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গেয়ারহার্ড শ্র্যোয়ডারের দপ্তরে গণমাধ্যম বিষয়ক সহকারী হিসাবে নিযুক্ত হন৷ এই পদের জন্য শ্র্যোয়ডার নিজেই স্টাইনমায়ারকে নির্বাচন করেছিলেন৷ এ প্রসঙ্গে লোয়ারস্যাকসনি রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গেয়ারহার্ড শ্র্যোয়ডার বলেন, ‘‘গণমাধ্যমবিষয়ক দায়িত্বপালন করার জন্য তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় আমার সঙ্গে৷ লক্ষ্য করলাম অন্যদের চেয়ে তিনি কিছুটা ভিন্ন রকমের৷ কোনোরকম জড়তা ছাড়াই ভেতরে ঢোকেন, জানান, কী তিনি করতে চান৷ তখন আমি মনে করলাম, হ্যাঁ এই ধরণের একজনকেই আমার প্রয়োজন৷''
অল্প কিছুদিন পরেই শ্র্যোয়ডারের আস্থা অর্জন করেন স্টাইনমায়ার৷ পদোন্নতি হয় তাঁর দপ্তর প্রধান হিসাবে৷ ১৯৯৮ সালে জার্মান সংসদ নির্বাচনে এসপিডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে লোয়ার স্যাকসনি রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গেয়ারহার্ড শ্র্যোয়ডার চ্যান্সেলার পদে আসীন হন৷ আর এই দায়িত্ব পালনের জন্য চ্যান্সেলার শ্র্যোয়ডারকে হানোফার থেকে জার্মানির তখনকার রাজধানী বনে যেতে হয়৷ পরে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে স্থানান্তরিত হলে বন থেকে চ্যান্সেলার শ্র্যোয়ডার যান বার্লিনে৷ ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ারও চ্যান্সেলার শ্র্যোয়ডার-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বন ও বার্লিনে যাত্রা করেন৷ সম্পৃক্ত হন চ্যান্সেলার- দপ্তরের কর্মকান্ডে৷ সরকারি সচিব হিসাবে গোয়েন্দা বিভাগের সমন্বয়বিষয়ক দায়িত্ব ন্যস্ত হয় তাঁর ওপর৷ ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে চ্যান্সেলার দপ্তরের প্রধান হন স্টাইনমায়ার৷ এবং এই পদে আসীন থাকেন ২০০২ সালে চ্যান্সেলর শ্র্যোয়ডার পরবর্তী দফায় সরকার গঠন করার পরও৷ পরমাণু বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনকেন্দ্রগুলি ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়া ও কর্মসংস্থান সংস্কারের দায়িত্ব বর্তায় তাঁর ওপর৷ ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর সংকট উত্তরণেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন ফ্রাঙ্ক ভালটার স্টাইনমায়ার৷
২০০৫ সালে এগিয়ে আনা সংসদ নির্বাচনে এসপিডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে শ্র্যোয়ডার রাজনীতি থেকে অবসর নেন৷ গঠিত হয় মহাজোট সরকার৷ আর এই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন স্টাইনমায়ার৷ খুব দ্রুতই তিনি জার্মান জনসাধারণের আস্থা অর্জন করেন৷ নির্বাচনের এক বছর পর জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে তিনি চ্যান্সেলার ম্যার্কেলকেও এক সময় ছাড়িয়ে যান৷
ফ্রাঙ্ক ভাল্টার স্টাইনমায়ার বিবাহিত, এক কন্যা সন্তানের পিতা৷ তাঁর স্ত্রী এলকে ব্যুডেনবেন্ডার একজন বিচারক৷ স্টাইনমায়ার পরিবারকে খুব একটা জনসমক্ষে দেখা যায়নি এতদিন৷ মাত্র সেদিন এবছরের জুন মাসে জার্মানির এক টিভি চ্যানেলের টকশোতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক ভালটার স্টাইনমায়ারকে দেখা গেল স্ত্রীর সঙ্গে৷ স্ত্রী ব্যুডেনবেন্ডার স্বামীর প্রশংসা করে বলেন, ‘‘আমার স্বামী একজন উঁচু মানের রাজনীতিক৷ তিনি কথা নয় কাজে বিশ্বাসী৷ তিনি পরিস্থিতি দেখে চিন্তা ভাবনা করে সমাধান বের করতে চান৷ তিনি মানুষের কাছে এগিয়ে যান, আলোচনা করে সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন৷''
এ বছরের জুন মাসে ইউরোপীয় নির্বাচনে এসপিডির ভরাডুবি হলে চ্যান্সেলার পদপ্রার্থী স্টাইনমায়ারের মনোবলও কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে৷ অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করার চেষ্টা করেন তিনি৷ মনে হচ্ছিল, নির্বাচন যুদ্ধ ঠিকমত শুরু হবার আগেই যেন তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন৷ কিন্তু ইউরোপীয় নির্বাচনের এক সপ্তাহ পরেই এসপিডির বিশেষ দলীয় সম্মেলনে তেজোদ্দীপ্ত এক বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন আত্মপ্রত্যয়ী স্টাইনমায়ার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘এ জন্যেই আজ আমি তোমাদের সামনে চ্যান্সেলার পদপ্রার্থী হিসাবে উপস্থিত হয়েছি৷ ২৭শে সেপ্টেম্বর একটি দিকনির্দেশক দিন৷ এই দিনই ঠিক হবে, কোন দিকে যাবে আমাদের দেশ৷ এবং তা শুধু চার বছরের জন্য নয় পরবর্তী দশ বছরের জন্য৷ আমি চাই সকল জার্মানের চ্যান্সেলর হতে ৷''
এসপিডি-এর বিমুগ্ধ সদস্যরা অনেকক্ষণ ধরে করতালি দিয়ে ধন্যবাদ জানান তাদের প্রার্থীকে৷ ইউরোপীয় নির্বাচনে পরাজয়ের গভীর বেদনা ও নৈরাশ্যের মুহূর্তে সাহস ও অনুপ্রেরণা জাগানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানান তারা স্টাইনমায়ারকে৷
প্রতিবেদক: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক