‘এসো গান শিখি’
২০ নভেম্বর ২০১২১৯৬৪ সালের কথা৷ বিটিভি সবে যাত্রা শুরু করেছে৷ পশ্চিম পাকিস্তান সরকার তখনো বাঙ্গালির সংস্কৃতির ওপর ডান্ডা ঘোরানোর চেষ্টায় নামেনি৷ টেলিভিশন চ্যানেল উদ্বোধনের পর প্রথম গান৷ শিল্পী ফেরদৌসি রহমান৷ দু দিন পর আবার ডাক পড়ে তাঁর৷ বলা হলো, একটা অনুষ্ঠান শুরু হবে, সেখানে বাচ্চাদের গান শেখাতে হবে৷ গান শেখানোয় খুব আপত্তি ছিল ফেরদৌসির৷ ততোদিনে বেশ প্রতিষ্ঠিত এবং খুব জনপ্রিয় হয়ে গেলেও মনে হচ্ছিল ‘‘গানের ভুবনে নিজেই তো শিক্ষার্থী, অন্যদের শেখাবো কী!'' কিন্তু মোস্তফা মনোয়ার আর কলিম শরাফির মতো দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বের অনুরোধ অগ্রাহ্য করা তো সম্ভব নয়, অগত্যা রাজি হতেই হলো৷ ক্ষতি হয়নি তাতে৷ ‘এসো গান শিখি'- ফেরদৌসি রহমানের এ আহ্বানে আজও বাংলাদেশের শিশু সংগীত শিক্ষার্থীরা ছুটে গিয়ে বসে টেলিভিশনের সামনে!
অথচ ৪৭ বছরে কত কী হয়েছে! পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের চরম বৈষম্যমূলক শাসননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে, তাদের লেলিয়ে দেয়া সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজের পরও পরাধীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে মুক্তিকামী বাঙালি৷ ১৯৬৪ সালের শিশুদের অনেকেই এখন ষাটোর্ধ প্রবীণ৷ গান গাইতে গেলে অনেকের কণ্ঠ কাঁপে, বেসুরো শোনায়৷ তবে এখনো বাড়িতে আছে ‘এসো গান শিখি'৷
‘এসো গান শিখি'র সঙ্গে কয়েক প্রজন্মের এমন সুরের বন্ধন সম্পর্কে ফেরদৌসি রহমান বলছিলেন, ‘‘সাতচল্লিশ বছর তো অনেকটা সময়৷ এ সময়ের মধ্যে কয়েকটা প্রজন্ম ধরে এ গানের অনুষ্ঠানের শ্রোতা তৈরি হয়েছে৷ কিছু ছেলেমেয়ে আছে যাঁরা ভালো গান করছে এখনো, আবার অনেকে গান গাইছে না, অন্যদিকে চলে গেছে৷ যেমন একটা ছেলে আছে ডালিম কুমার, সে আমার কাছে গান শিখতো এখন অনেক ভালো অ্যাকুইস্টিকস বাজায়৷ তারপর হুমায়ূন আহমেদ সাহেবের স্ত্রী শাওন আছে যে ভালো গান করে৷ ‘এসো গান শিখি' থেকে আরো অনেক শিল্পী বেরিয়েছে৷''
৪৭ বছর আগের শিক্ষার্থীদের কারো কারো সন্তান, সন্তানের সন্তান, এমনকি তাদের সন্তানও গান শিখেছেন বা শিখছে ফেরদৌসি রহমানের কাছে৷ নিজের বয়সও ৭০ ছাড়ালে কী হবে, বরেণ্য শিল্পী ফেরদৌসি এখনো তরুণ, কণ্ঠ এখনো তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে৷
‘এসো গান শিখি'র শুরুটা হয়েছিল অবশ্য অন্য নামে৷ প্রথম দু বছর নাম ছিল ‘‘সংগীত শিক্ষার আসর৷'' তারপর দু বছর বন্ধ থাকার পর আবার যখন শুরু হলো তখন থেকেই নাম ‘এসো গান শিখি৷' সময়ের দাবিতে পরিবর্তন এসেছে কিছু৷ শিশুদের খেলার ছলে, মজা করে করে গান শেখাতে অনুষ্ঠানে যোগ হয়েছে পাপেট ‘মিঠু' আর ‘মন্টি'৷ তারা আছে আর আছেন ফেরদৌসি৷ নিজের লেখাপড়া, শিল্পী হিসেবে বিদেশ সফর বা অনুষ্ঠান একঘেয়েমি আসতে না দেয়ার ভাবনা থেকে ফেরদৌসির সানন্দ সম্মতিতে আজাদ রহমান, কলিম শরাফি, খান আতাউর রহমান এবং ফিরোজা বেগমও গান শিখিয়েছেন এ অনুষ্ঠানে৷ সেই পরিবর্তন অনেক আগের এবং খুবই কম সময়ের জন্য৷ ওই অতি সাময়িক পরিবর্তনগুলো বাদ দিলে ‘এসো গান শিখি' আর ফেরদৌসি রহমান অবিচ্ছেদ্য ছিলেন এবং সবাইকে অবাক করে এখনো আছেন!
বিষয়টি খুব অবাক হবার মতো, কেননা, বাংলাদেশে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিটিভিও বদলায়৷ শিল্পী-তালিকায় আমূল পরিবর্তন তো তখন অনিবার্য৷ সবার সৌভাগ্য যে ‘এসো গান শিখি'কে সেরকম পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে হয়নি কখনো৷ এ অনুষ্ঠান নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনে ফেরদৌসি রহমানও সেরকমই জানিয়েছেন৷
কিন্তু তাঁকে রাখলেও অনুষ্ঠানকে অনাগত আগামীর জন্য ধরে রাখার কোনো উদ্যোগ কি নিয়েছে বিটিভি? সিডি বা ডিভিডিতে অন্তত সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ কি নেয়া হয়েছে এখনো? আব্বাস উদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা ফেরদৌসি জানালেন, ‘‘না, ডিভিডি-সিডি নেই, তবে ১৩টা গান নিয়ে আমি একটা অডিও সিডি বের করেছি৷ ওটার এখনো অনেক চাহিদা রয়েছে৷ এখনো অনেকে, বিশেষ করে বিদেশে গেলে অনেকে আমাকে বলে যে, এরকম আরো সিডি কেন বের করছেন না, বের করলে আমাদের সন্তানরা, যারা বিদেশে বড় হচ্ছে, তারা একটু বাংলা গান শিখতে পারতো৷ ডিভিডির কথাও অনেকেই আমাকে বলেছেন৷ কিন্তু এ সম্পত্তিটা (এসো গান শিখি) তো আসলে বিটিভির সম্পত্তি৷ তারা বোধহয় এটা ভালোভাবে সংরক্ষণও করেননি৷''
কিছুদিন হলো অনুষ্ঠান চলছে খুব দায়সারাভাবে৷ দেশের সবচেয়ে পুরনো এবং শিশুদের গান শেখানোর একমাত্র অনুষ্ঠানটি এখন আর সাপ্তাহিক নেই, দু'সপ্তাহ পরপর একদিন প্রচারিত হয় ‘এসো গান শিখি'৷ তা-ও আবার সবসময় নির্দিষ্ট সময়ে নয়৷ অনুষ্ঠানটির এখন কী অবস্থা – জানতে চাওয়ায় বড় দুঃখ নিয়েই নিজের অসন্তোষের কথা জানালেন ফেরদৌসি রহমান, ‘‘এখন হচ্ছে অনুষ্ঠানটা৷ দু'সপ্তাহ পরপর শনিবারে দেখানো হচ্ছে৷ আমি এ নিয়ে খুব বেশি খুশি নই৷ এটা প্রত্যেক সপ্তাহে যদি ঠিক সময়মতো না যায়, বাচ্চারা একটা সপ্তাহ যদি দেখতে না পায়, তাহলে উৎসাহটা চলে যায়৷ আমি ওদের (বিটিভি) সঙ্গে এ নিয়ে কিছুটা কথাও বলেছি যে, আপনারা আদৌ যদি প্রোগ্রামটা কনটিনিউ করতে চান, দেন ডু ইট সিরিয়াসলি৷''