করোনা আতঙ্ক: বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু
৩০ এপ্রিল ২০২০তিনি অসুস্থ ছিলেন না। দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন করোনা-লকডাউন শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগেও। গত ২৩ এপ্রিল হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয় সুব্রত দাসের। হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু করোনা-আতঙ্কে চিকিৎসা তো দূরের কথা, হাসপাতালেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। পরিবারের অভিযোগ বিনা চিকিৎসায় রাস্তাতেই মৃত্যু হয়েছে সুব্রতবাবুর।
এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। গোটা দেশ জুড়ে এমনই ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিদিন। সরকার দায় চাপাচ্ছে হাসপাতালের ওপর, হাসপাতাল সরকারের ওপর। আর চিকিৎসা না পেয়ে বেঘোরে মারা যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
সুব্রতবাবুর ঘটনার দিকেই চোখ রাখা যাক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁর মেয়ে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন তাঁর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা। দিল্লির বাঙালি পাড়া চিত্তরঞ্জন পার্কে থাকতেন ৬৫ বছরের সুব্রতবাবু। মেয়ে এবং জামাইয়ের বাড়ি পাশেই। ২৩ তারিখ সকালে সুব্রতবাবুর হঠাৎই বুকে ব্যথা শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁর অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন সকলে। কিন্তু লকডাউনের মধ্যে অ্যাম্বুল্যান্স পেতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সুব্রতবাবুর মেয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য পুলিশ, হাসপাতাল সর্বত্র ফোন করেছি। এমার্জেন্সি নম্বরে বার বার ফোন করেছি, লাভ হয়নি। বেশ কিছুক্ষণ এ ভাবে চলার পরে কোনও মতে একটি অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা হয়। তাতে তুলে বাবাকে সব চেয়ে কাছের বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু সেই হাসপাতাল ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে পর্যন্ত বাবাকে নিয়ে যেতে দেয়নি। আমাদের বলা হয়, এ ভাবে করোনা ছড়াবেন না। রোগীকে নিয়ে হাসপাতাল চত্বরের বাইরে চলে যান।''
করোনার কোনও লক্ষণই ছিল না সুব্রতবাবুর। বার বার তা বলা সত্ত্বেও প্রথম হাসপাতালটি রোগীর পরিবারের কথা শুনতে চায়নি। অগত্যা, আরেকটু বড় এবং রীতিমতো নাম করা একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সুব্রতবাবুকে। ততক্ষণে তাঁর শরীর শক্ত হয়ে গিয়েছে। অভিযোগ, সেই হাসপাতালেও সুব্রতবাবুকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সুব্রতবাবুর মেয়ের দাবি, চিকিৎসকরা জানান, এই পরিস্থিতিতে কোনও রোগীকে ইমার্জেন্সিতে দেখাও সম্ভব নয়। এখানেই শেষ নয়, অ্যাম্বুল্যান্সের চালক তাঁদের বলেন, প্রতিদিন এ ভাবেই রোগীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলি। ফলে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে আর লাভ নেই। একই অভিজ্ঞতা হবে।
সুব্রতবাবুর মেয়ে জানিয়েছেন, ''শুধু বাবাই নয়, দ্বিতীয় হাসপাতালটির বাইরে আরও এক হার্টের রোগীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাঁকেও হাসপাতালে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না ইমার্জেন্সির চিকিৎসকরা।'' বাড়ি ফেরার পরে কোনও মতে এক পরিচিত চিকিৎসককে ডেকে আনা হয়। তিনি এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেন। পরিবারের দাবি, হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু পেলে হয়তো বাঁচানো যেত সুব্রতবাবুকে। কার্যত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর।
দিল্লি মেডিকেল কাউন্সিলের সভাপতি অরুণ কুমার গুপ্ত জানিয়েছেন, কোনও হাসপাতাল এ ভাবে রোগী ফেরত পাঠাতে পারে না। এটা হাসপাতালের প্রোটোকল-বিরোধী। এ ক্ষেত্রেও দু'টি বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেছেন দিল্লির বহু চিকিৎসক। অন্তত তদন্ত করে দেখা উচিত, কেন সুব্রতবাবুকে ইমার্জেন্সিতেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একাধিকবার এ বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। হাসপাতালগুলিকে বার বার তারা অনুরোধ করেছে, যেন করোনার জন্য সাধারণ রোগীদের চিকিৎসায় গাফিলতি না হয়। দিন কয়েক আগে পোপও আফ্রিকার উদাহরণ দিয়ে একই কথা বলেছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে স্পষ্ট অ্যাডভাইসারি বা নির্দেশিকা জারি করেছে। যাতে বলা হয়েছে, কোনও হাসপাতাল সাধারণ রোগীদের চিকিৎসায় গাফিলতি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তব বলছে, এ সবই কথার কথা।
শুধু দিল্লি নয়, গোটা দেশেই একই চিত্র। দক্ষিণ ভারতের একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ওপিডি বা আউটডোর বন্ধ করে দিয়েছে। কলকাতায় বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ উঠছে যে, তারা রোগী ভর্তি করতেই চাইছে না। সরকারি হাসপাতালগুলির অবস্থাও তথৈবচ। করোনা আতঙ্কে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি হাসপাতালগুলির বিভিন্ন ওয়ার্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে কলকাতার ঠাকুরপুকুরের ক্যান্সার হাসপাতাল। গরিব ক্যান্সার রোগীদের একমাত্র যাওয়ার জায়গা। বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল কার্যত রোগী ভর্তিই বন্ধ করে দিয়েছে বলে সূত্র জানাচ্ছে। যদিও সরকারি ভাবে হাসপাতালগুলি সে কথা স্বীকার করছে না। কিন্তু তাদের রোগী ভর্তির খাতা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, গত কয়েক দিনে কাওকে ভর্তি নেওয়া হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের একটি সরকারি হাসপাতালের প্রাক্তন সুপার চিকিৎসক সাত্যকি হালদার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''এ গুলো মর্মান্তিক ঘটনা। আসলে বেসরকারি হাসপাতালগুলি আগেও ব্যবসা করতো, এখনও ব্যবসা করছে। ফলে তাদের অমানবিক মুখ বার বার বেরিয়ে পড়ছে। তবে একই সঙ্গে আরও একটি কথা বলা দরকার। চিকিৎসকদের একাংশের মধ্যেও ভয় তৈরি হয়েছে। এখনও বহু ডাক্তারের কাছে ন্যূনতম নিরাপত্তা পোশাকটুকু পৌঁছয়নি। করোনা নিয়ে সাধারণ লোক যেমন আশঙ্কিত হয়ে আছেন, ডাক্তারদের একটি অংশও তেমনই আশঙ্কিত। তবে বিশ্ব জুড়ে এই সব কিছু উপেক্ষা করে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন বহু চিকিৎসক। মারাও যাচ্ছেন। তাঁরা প্রমাণ করে দিচ্ছেন, বড় বড় দেশগুলির হাতে আনবিক অস্ত্র আছে, কিন্তু পিপিই দেওয়ার ক্ষমতা নেই।''
দিল্লির চিকিৎসক সুব্রত কুণ্ডু ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''গত এক মাস ধরে সাধারণ রোগীরা এ ভাবে সমস্যায় পড়ছেন। আসলে কার করোনা আছে, আর কার করোনা নেই, সেটা বোঝা খুব মুশকিল। এই ঘটনাগুলি বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা করোনা পরিস্থিতি সামলানোর জন্য তৈরিই নই। সেই পরিকাঠামোটাই তৈরি করা যায়নি। চিকিৎসকরাও জানেন না, কার করোনা হয়েছে। গঙ্গারাম হাসপাতালে একজন হার্ট পেশেন্টকে দেখতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর করোনা হয়ছে। সঙ্গে সঙ্গে ৩০ জন চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীকে কোয়ারান্টিনে পাঠানো হযেছে। সমস্যা দুই দিকেই রয়েছে।''
রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে অবশ্য বার বার বলা হচ্ছে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা করতেই হবে। কিন্তু কে শুনছে কার কথা? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসকের বক্তব্য, যে সমস্ত হাসপাতাল রোগীদের সঙ্গে এই দুর্ব্যবহার করছে, সহজেই তাদের শাস্তি দিতে পারে স্বাস্থ্যমন্ত্রক বা মেডিকেল কাউন্সিল। কিন্তু সে কাজটা হয় না। ভিতরে ভিতরে 'দেওয়া-নেওয়ার' সম্পর্কের অভিযোগ অনেক সময়ই ওঠে। সেই সম্পর্ক যদি থাকে তা হলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।