করোনা কি ঠেকানো যেত?
১৬ জুলাই ২০২১
বাংলাদেশকে করোনার দুইটি ঢেউ অনেকটাই বিপর্যস্ত করে দিয়েছে৷ প্রথম ঢেউটি ছিল গত বছর উহান করোনার৷ আর দ্বিতীয় ঢেউটি এবছর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের৷ প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ কি করোনা ঠেকাতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছিল?
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ৷ জুলাই মাসে করোনা সংক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়৷ এরপর কমে আসলেও এখন আবার করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে৷ বাংলাদেশে এপর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ১৭ হাজার ২৭৮ জন৷ শনাক্ত হয়েছেন ১০ লাখ ৭১ হাজার ৭৭৪ জন৷ এখন প্রতিদিন মৃত্যু দুইশ’র উপরে৷ আর এই মাসেই করোনায় সর্বোচ্চ সংখ্যায় মারা যাচ্ছেন৷
বাংলাদেশে করোনা টেস্টের ওপর নির্ভর করছে শনাক্তের সংখ্যা৷ এখন প্রতিদিন গড়ে ৪০ হাজার নমুনা পরীক্ষা হয়৷ তবে এই টেস্ট বাড়ানো হলে সঠিক পরিস্থিতি বোঝা যেত৷
গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার আগেই করোনা ঠেকাতে বিমান ও স্থল বন্দরে বিশেষ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ আর চলতি বছরের মে মাসে সীমান্ত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সনাক্ত হওয়ার পরও ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়৷ কিন্তু কাজ হয়নি৷ করোনা ঠেকানো যায়নি৷ আইসোলেশন, কোয়ারান্টিন ঠিকমত না করায় এই পরিস্থিতি হয়েছে৷ গত বছর করোনা ছিলো ঢাকা ও শহর কেন্দ্রিক৷ কিন্তু এবার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এখন শহরের চেয়ে গ্রামে সংক্রমণ বেশি৷ আর গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে পরিস্থিতি অনেক খারাপ৷
করোনার টিকা নিয়েও বাংলাদেশকে হোঁচট খেতে হয়েছে৷ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশেকে অক্সফোর্ডের তিন কোটি ডোজ টিকা দেয়ার চুক্তি করলেও শেষ পর্যন্ত তারা ৭০ লাখের বেশি টিকা দেয়নি৷ ফলে গত ৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়ার গণটিকা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়৷
এই করোনা ঠেকাতে গত বছর টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি দিয়ে সব কিছু বন্ধ রাখা হয়৷ আর এবারও লকডাউন ও কঠোর লকডাউ দেয়া হচ্ছে৷ দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউন শেষ হয়েছে ১৪ জুলাই৷ কিন্তু এই এই লকডাউনও সঠিকভাবে করা হয়নি৷ আর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ও মাস্ক পরাতে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা কম৷ ফলে করোনা ছড়াচেছ দ্রুত৷
তাই বিশ্বের অনেক দেশ করোনা পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এলেও বাংলাদেশে দীর্ঘায়িত হচ্ছে৷
জাতীয় পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ বলেন,“১৫ জুলাই থেকে আমরা আরও দুই সপ্তাহের লকডাউনের প্রস্তাব করেছিলাম৷ কিন্তু উল্টো শিথিল করা হয়েছে৷ এতে করোনা আরো ছড়িয়ে পড়বে৷ আর লকডাউন এর আগে ঢিলেঢালা হওয়ায় সংক্রমণ কমানো যায়নি৷”
বিএসএমইউ এর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন,“কোনো দেশই করোনা ঠেকাতে পারেনি৷ বাংলাদেশের পক্ষেও সম্ভব ছিল না৷ তবে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে আমরা এখনো করোনা বিদায় করতে পারছি না৷”
তিনি বলেন,“লকডাউন, ভ্যাকসিন, চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের ব্যবস্থাপনার সংকট এবং সমন্বয়ের অভাব শুরু থেকেই আছে৷ আছে করোনার সময় স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি৷ ফলে বাংলাদেশ করোনা থেকে বের হতে পারছে না৷”
তার মতে, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে লকডাউন পুরোপুরি সম্ভব না৷ গত ঈদে এক কোটি মানুষ মহানগর থেকে গ্রামে গেল৷ ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷’’
এই বৈশ্বিক মহামারি পৃথিবীর কোনো দেশই ঠেকাতে পারেনি৷ তবে সঠিক এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষয় ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা যেত বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী৷ তিনি বলেন,“আমরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে এটা মোকাবেলার চেষ্টা করিনি৷ আমরা কোনো পরিকল্পনা করিনি৷ এপিডেমিক প্রজেকশন করতে হয় তা আমরা করিনি৷ ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা দীর্ঘায়িত হচ্ছে৷ যেভাবে চলছে তাতে বাংলাদেশ ঠিক কবে করোনা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে তা বলা কঠিন৷”
তবে জাতীয় পরামর্শক কমিটির প্রধান ডা. মো শহীদুল্লাহ মনে করেন,“বাংলাদেশ যে খুব খারাপ করেছে তা নয়৷ ভারত, ব্রাজিলসহ অনেক দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের পারফরমেন্স তত খারাপ না৷ তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা করা গেলে পরিস্থিতি আরো ভাল করা সম্ভব ছিল৷’’
আর বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ মনে করেন,“ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এর চেয়ে আর ভালো কিছু করা সম্ভব নয়৷ এখানকার মানুষ মনে করে তারা করোনায় নয়, না খেয়ে মারা যাবেন৷ তাই করোনা ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কাছে৷”