করোনা টেস্টের ফি নির্ধারণ, বিশেষজ্ঞদের ভিন্ন মত
২৯ জুন ২০২০স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা-১ অধিশাখা থেকে সোমবার জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আরটি-পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নির্ণয় করা হয়৷ বর্তমানে এ পরীক্ষা সরকার বিনামূল্যে করার সুযোগ দিচ্ছে৷ ফলে কোনো উপসর্গ ছাড়াই অধিকাংশ মানুষ এ পরীক্ষা করানোর সুযোগ গ্রহণ করছেন৷ এ অবস্থায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য অপ্রয়োজনীয় টেস্ট পরিহার করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের গত ১৫ জুনের এক স্মারকের সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার জন্য ২০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ফি নির্ধারণ করা হলো৷
প্রজ্ঞাপনে আরো বলা হয়েছে, আরটি-পিসিআর পরীক্ষার জন্য আদায় করা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে৷ ‘চিকিৎসা সুবিধা বিধিমালা ১৯৭৪'-এর আওতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য চিকিৎসা সংক্রান্ত সব সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকবে৷ এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা, দুঃস্থ ও গরিব রোগীদের চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত সরকারি আদেশ বহাল থাকবে৷ হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের নমুনা পরীক্ষাতেও খরচ হবে ২০০ টাকা৷ সরকারি সব হাসপাতালের জন্য এ ফি প্রযোজ্য হবে৷
কেন ফি নির্ধারণ করতে হলো? প্রেক্ষাপট কী? জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জনস্বার্থের কথা চিন্তা করেই এই ফি নির্ধারণ করা হয়েছে৷ এখন যাদের প্রয়োজন নেই তারাও বিনা কারণে একাধিকবার টেস্ট করাচ্ছেন৷ ফি নির্ধারণের ফলে যাদের প্রয়োজন নেই তারা আর টেস্ট করাতে যাবেন না৷’’
অনেক মানুষের তো ২০০ টাকা দিয়ে টেস্ট করানোর সামর্থ্য নেই? যারা খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা কীভাবে টেস্ট করবেন? জবাবে সচিব বলেন, ‘‘২০০ টাকা দেওয়ার সক্ষমতা আছে৷ একজন রিক্সাচালক কত টাকা আয় করেন? করোনার মধ্যেও কিন্তু রিক্সা চলছে৷ সরকার মনে করছে, ন্যূনতম একটা ফি থাকলে যাদের প্রয়োজন নেই, তারা আর টেস্ট করাতে যাবেন না৷’’
তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘একটা টেস্টের পেছনে সরকারের ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়৷ সেখানে ২০০ টাকা নিয়ে কতটা এগুবে? বরং ফ্রি থাকলে ধনী-গরীব সবাই টেস্ট করাতে যেতেন৷ এখন যার খাবারেরই সমস্যা তিনি কীভাবে টেস্ট করাতে যাবেন? সবাই টেস্ট করাতে না গেলে সমাজের আসল চিত্রটা জানা যাবে না৷ আর টেস্ট করানোর দায়টা তো স্বাস্থ্য বিভাগের৷ জনগণ বুথে এসে নমুনা দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করছে৷ তাহলে যে আপনাকে সহযোগিতা করছে, তার কাছ থেকে উলটো পয়সা নেবেন? আর এই সিদ্ধান্তটা অসাংবিধানিকও৷ সংবিধানে সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবার কথা বলা আছে৷ এখন এই সেবাটা আর সবার থাকলো না৷’’
ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এখন শুধু যাদের ফি দেওয়ার ক্ষমতা আছে তারাই করোনা পরীক্ষা করবেন৷ যাদের সংসার চলছে না, ২০০ টাকা হলে ৫ কেজি চাল কিনতে পারেন- এমন কেউ আর পরীক্ষা করাতে যাবেন না৷ ফলে সমাজে করোনা বিস্তৃতির সঠিক চিত্রটা আর পাওয়া যাবে না৷ শুধুমাত্র পয়সাওয়ালাদের মধ্যে কী পরিমাণ বিস্তৃতি লাভ করেছে সেটাই জানা যাবে৷ সারাদেশের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে কোনো ধরনের পরিকল্পনার সুযোগও আর থাকলো না৷’’
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলালও মনে করছেন, ফি নির্ধারণ না করলেই ভালো হতো৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘বিনা কারণে অনেকেই টেস্ট করাচ্ছেন এটা যেমন সত্যি, তেমনি ২০০ টাকা দিয়ে টেস্ট করানোও অনেকের জন্য কঠিন৷ এটাও মানতে হবে৷ তারপরও আমি মনে করি, সরকার তো কতকিছুতেই ভরতুকি দিচ্ছে, তাহলে এই টেস্ট ফ্রি রাখলেই ভালো হতো৷’’
বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা হয় ২১ জানুয়ারি৷ প্রথম দিকে শুধু রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পরীক্ষা করা হলেও সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এপ্রিলের শুরুতে ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানো হয়৷ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ৷ এরপর ২৯ এপ্রিল প্রথমবারের মতো চারটি বেসরকারি হাসপাতালকে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সুযোগ দেয় সরকার৷ পরে আরও কয়েকটি হাসপাতালে পরীক্ষা শুরু হয়৷ এসব হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষার জন্য সাড়ে ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার৷ তবে বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে বাসায় গিয়ে নমুনা নিলে সাড়ে ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে৷
বর্তমানে দেশের ৬৮টি ল্যাবে কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে৷ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নমুনা পরীক্ষার কিট সরবরাহ করছে সরকার৷ এখন দৈনিক নমুনা পরীক্ষা ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে৷ সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত দেশে মোট ৭ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে৷