করোনা ট্র্যাকিং অ্যাপ দিয়ে নজরদারির অভিযোগ
৬ মে ২০২০নাম আরোগ্য সেতু অ্যাপ। করোনা নিয়ে সব তথ্য সেখানে রয়েছে, আর রয়েছে একটা বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। কেউ যদি করোনায় আক্রান্ত হন, তা হলে সেটা ধরা পড়ার ১৪ দিন আগে কারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন, তা অ্যাপ জানিয়ে দেবে। যদি অ্যাপ ব্যবহারকারী কেউ করোনায় আক্রান্তের সংস্পর্শে আসেন, তা হলে নিজেকে কোয়ারান্টিনে রাখতে হবে। তারপর অ্যাপই বলে দেবে, কবে তিনি আবার বাইরে যেতে পারবেন। অ্যাপ এটাও বলে দেবে কখন বেরনোটা তুলনায় নিরাপদ। কোথায় করোনা হয়েছে, কতজন আক্রান্ত, করোনা হলে কী করতে হবে, করোনা ঠেকাতে কী করতে হবে, কাছাকাছি কোন দোকান খোলা, তাও বলে দেবে অ্যাপ।
আর মোদী সরকার ফরমান জারি করেছে, সব কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীকে এই অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে। এমনকী বেসরকারি সংস্থায় যাঁরা কাজ করেন, তাঁদেরও বাধ্যতামূলকভাবে অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে। বেসরকারি অফিসের কর্তা নিশ্চিত করবেন, যাতে সকলে এই অ্যাপ ডাউনলোড করেন। যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যের দিল্লি ঘেঁষা শহর নয়ডার ফরমান আরও কঠোর। অ্যাপ ডাউনলোড না করলে এক হাজার টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের জেল। শুধু সরকারি বা বেসরকারি অফিসের কর্মী নন, এই অ্যাপ সকলকে ডাউনলোড করতে হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই অ্যাপ নিয়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছে। একাধিক সংগঠন দাবি করেছে, এই অ্যাপ লোকের গোপনীয়তার অধিকার ভঙ্গ করছে। এই অ্যাপ ব্লুটুথ ও জিপিএসের মাধ্যমে কাজ করে। যাঁর কাছে এই অ্যাপ আছে, তার গতিবিধি রেকর্ড হয়ে যায়। তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে দেখা করছেন, সেটা যেমন জানা যায়, তেমনই তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য, তাঁর কনট্যাক্টস সহ সব তথ্যই পৌঁছে যাচ্ছে সরকারের কাছে। ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের মতে, ''ভারতে একটা সামগ্রিক ডেটা প্রটেকশন আইন নেই। নজরদারি নিয়ে যে আইন আছে তা মান্ধাতার আমলের। বিপর্যয়ের সময় ত্রাণ দেওয়ার জন্য যে অ্যাপ চালু করা হয়, তা মূলত কনট্যাক্ট ট্রেসিং করতে। অনেক সময় তা লোকেদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগানো হয়। এই অ্যাপ লোকের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করবে, ফলে তাঁর গোপনীয়তা সংকটে পড়বে। তাদের মতে সিঙ্গাপুরে এই ধরনের অ্যাপ আছে। কিন্তু তার তথ্য কেবলমাত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রক ব্যবহার করতে পারে। এখানে কোন মন্ত্রক ব্যবহার করবে, তা স্পষ্ট করে বলা নেই।''
রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের দলনেতা ডেরেক ও ব্রায়েন ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''বিগ ব্রাদার সকলের ওপর নজর রাখছে। এটা সব চেয়ে খারাপ ধরনের রাজনৈতিক ধোঁকা। লোকে যখন অসুরক্ষিত অবস্থায় আছে, তখন প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার করা উচিত ছিলো। মোদী-শাহের বিজেপি আমাদের এটা বিশ্বাস করাতে চায়, আরোগ্য সেতু অ্যাপ কিছুদিনের মধ্যেই বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু আমি বলছি, বাতিল হবে না।''
বিতর্ক বাড়ছে দেখে সরকারের তরফে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, অ্যাপের গোপনীয়তারনীতিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সকলের সুবিধার জন্যই ব্যবহারকারীর লোকেশন বা তিনি কোথায় আছেন, সেই তথ্য নেওয়া হয় এবং তা সার্ভারে নিরাপদে এনক্রিপ্ট করে রাখা হয়। তিনি স্বেচ্ছায় কনট্যাক্টদের সম্পর্কে তথ্য দিলে তা স্টোর করে রাখা হয় এবং তিনি করোনায় আক্রান্ত হলে তবেই তা দেখা হয়। সমানে এই অ্যাপকে আরও উন্নত করা হচ্ছে এবং পরীক্ষা করা হচ্ছে। ফলে সকলের ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপদ ও গোপন আছে। টিম আরোগ্য সেতু জানিয়েছে, কারও কোনও তথ্য ফাঁস হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, ভারতে গোপনীয়তার অধিকার হলো মৌলিক অধিকার। ফলে সেই অধিকার ভঙ্গ হলে সেটা নিঃসন্দেহে গুরুতর বিষয়। এর আগে আধার কার্ড বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা নিয়েও অভিযোগ উঠেছিলো যে, এটা গোপনীয়তার অধিকার ভঙ্গ করছে। তখনও অভিযোগ উঠেছিলো, আধারের তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীকালে তথ্য ফাঁসের কিছু উদাহরণও সামনে আসে। সামাজিক মাধ্যমে নজরদারি নিয়েও একই অভিযোগ করা হয়েছিলো। সুপ্রিম কোর্ট রায়দেয়, আধারকে বাধ্যতামূলক করা যাবে না।
একসময় সরকার কিছু সাংবাদিকের ফোন ট্যাপ করছে বলে অভিযোগ ওঠে। সেই তালিকায় ছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''এই ভাবে অ্যাপের মাধ্যমে সব ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে কি করোনা ঠেকানো যায়? এই ভাবে লোকের ওপর নজরদারি করা যায়। এই অ্যাপ ডাউনলোড করলেই ব্লুটুথ ও জিপিএস চালু হয়ে যায়। ফলে গতিবিধি সহ ব্যক্তিগত সব তথ্য সরকারের কাছে চলে যাবে। লোকের ওপর নজরদারি রাখা সম্ভব হবে। তাছাড়া সরকার একটা অ্যাপ চালু করতেই পারে। কিন্তু তা বাধ্যতামূলক করবে কেন? বাধ্যতামূলকভাবে ডাউনলোড করতে হলে, তার সব শর্ত মানতেই হবে। তাই স্বেচ্ছায় ফোনের সব কনট্যাক্টস সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে কী করে?''
তথ্যের অধিকার ও তার অপব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসা সুমন সেনগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''একটা মহামারিকে সামনে রেখে এই অ্যাপ চালু করা হয়েছে। কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য হলো মহামারির পরেও মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে ভারতকে একটা নজরদারি রাষ্ট্রে পরিণত করা।'' সরকারি ব্যাখ্যার পরেও বিতর্ক থামছে না। বরং বাড়ছে।