করোনা দুষ্টুটা!
১৩ মার্চ ২০২০যাই হোক, গৌরচন্দ্রিকা রেখে আসল কথা পাড়ছি৷ করোনা ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে৷ মানুষ আতঙ্কিত! সেদিন বাড়িতে ফোন করলাম৷ ধরে ধরে তিন প্রজন্মের সবার সঙ্গে কথা বললাম৷ সবাই কিছুটা ভীত৷ তা ভয় পাবার যথেষ্ট কারণ আছে বটে৷ কিন্তু ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাাপে যেভাবে আতঙ্ক বিনিময় করা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে বিপদ যেন সিনবাদের ভূত হয়ে চেপেছে ঘাড়ে৷ আর নামবে না৷
বাড়ির লোকেরা রেগে টং হয়ে গেলেন যখন জানতে পারলেন এই ‘দুঃসময়ে’ আমি পূর্ব ইউরোপে হাওয়া খেতে গিয়েছিলাম৷ তো তাদের এই বুঝিয়ে শান্ত করলাম, যে সেখানকার পরিস্থিতি জার্মানির চেয়ে অন্তত ভালো৷ আসলে আমার এক বন্ধু এসেছিলেন কাজে, হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে৷ কাজ দফারফা করে ফের বললেন, বন্ধু এবার চল কলা বেঁচবো৷ আমিও লুঙ্গি মেরে টান দিলাম দৌঁড়৷ তো আমরা বুদাপেস্ট, ব্রাতিস্লাভা, ভিয়েনা, প্রাগ, বার্লিন ঘুরে বেড়ালাম৷ একটি বিশেষ কাজে আমাকে ফিরে আসতে হল বন৷ আর বন্ধুটি ঘুরে বেড়ালেন ওয়ারশ, অসলো, কোপেনহেগেন, ব্রাসেলস৷ এরপর কোলন ও বন ঘুরে ফিরে গেলেন ঢাকা৷
আমি আপাতত ইউরোপেই গাঁট বেধেছি৷ তাই আমার প্রসঙ্গ থাক৷ বন্ধুটির অভিজ্ঞতার কথা বলি৷ সেটি একেক শহরে একেকরকম৷ তিনি ওয়ারশতে দেখলেন, এই অসময়েও লোকেরা রাস্তায় গানবাদ্য করছে, অস্থির হলেন প্রাগের লোকারণ্য চার্লস ব্রিজে পা ফেলার জায়গা না পেয়ে আর মুগ্ধ হলেন শ্লোভাকদের আতিথেয়তায়৷ তবে হতবাক হলেন বার্লিনের পথে নেমে৷ শনিবার রাতে রাস্তায় লোক নেই৷ রোববার সকাল এমনিতেই একটু নিষ্প্রাণ থাকে৷ কিন্তু এদিন একটু বেশিই ছিল কি না কে জানে!
এমন নয় যে, ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টিকে হেলাফেলা করে এড়িয়ে গেছি আমরা৷ যতটা সম্ভব সতর্কই ছিলাম৷ বারবার হাত ধুয়েছি৷ মুখে হাত দিইনি৷ টিস্যু কাগজ ব্যবহার করেছি হাঁচি কাঁশি এলে৷ ব্যবহারের পর তা যথাস্থানে ফেলে দিয়েছি৷ কিন্তু আতঙ্কিত হইনি, কিংবা আমাদের মত আতঙ্কিত নন, কিন্তু সতর্ক এমন লোকও দেখেছি ঢের৷
তো ভ্রমণের সময়টা জুড়ে আমাদের আলাপচারিতায় বারবারই এসেছে এই করোনা ভাইরাস প্রসঙ্গ৷ এমনকি দিনভরই টুইটার, ফেসবুকের ফিডে আসা খবরগুলো ঘেটেঘুটে দেখছিলাম৷ তো প্রথম থেকেই আমরা ব্যাপক বিরক্ত একটি বিষয়ে৷ তা হল, যেভাবে সবাই পোঁ ধরে সব কিনে নিয়ে যাচ্ছে দোকানগুলো থেকে, তাতে গুগল অনুবাদকে ‘স্যানিটাইজার' অর্থ ডুমুরের ফুল লিখে দিলে ঘটিরামটাকে ক্ষমা করে দিতাম৷
তো এখন একই কায়দা শুরু হয়েছে বাংলাদেশেও৷ মাস্ক, স্যানিটাইজার এসব নাকি শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ গুজবও ছড়াচ্ছে অনেক৷ সেদিন এক বন্ধু দেখালেন একটি আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেলের খবরের একটি স্ক্রিনশট৷ ব্রেকিং নিউজে বলা হচ্ছে, প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে৷ আবার আরেকটিতে দেখলাম, কোকেন খেলে নাকি করোনা ভাইরাস মরে যায়৷ অথচ কোকেন বাবাজি নিজেরই শ্বাসকষ্ট আছে৷ আর গুজবেরও শেষ নেই৷ কোথায় না জানিয়ে লাশের পর লাশ পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, কোথায় পুঁতে ফেলা হচ্ছে, এসব খবরে আতঙ্কিত সবাই৷ সব মিলিয়ে একেবারে জগাখিচুড়ি৷
যে কোনো সংকটকালে গুজব ছড়াবেই৷ তাই সেখানে গণমাধ্যমের ভুমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ তো সেখানেও ব্যত্যয় দেখা গেছে৷ যেমন, বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি৷ কিন্তু তার আগেই কেউ ঘোষণা দিয়ে দিলেন আগামী মাস থেকে সব বন্ধ৷ এ ধরনের ঘোষণা মানুষের মাঝে আতঙ্ক তৈরি করে৷ সেক্ষেত্রে একেবারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আবার আগ পর্যন্ত এমন খবর প্রচার করাই উচিত নয়৷ সব খবর ব্রেকিং নিউজ নয়৷
গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ সেখানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার অধ্যাপক কারিন ভাল-ইয়োর্গেনসেনের একটি গবেষণাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, প্রায় একমাস ধরে খবর বিশ্লেষণ করে তিনি প্রায় ১১শ’টি খবরে ‘ভয়’ অথবা ‘ভীত’ শব্দটি পেয়েছেন৷ অন্তত ৫০টি রিপোর্টে রোগের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘কিলার ভাইরাস’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷
ভয় সংক্রামক৷ একটি ভয়ের খবর প্রকাশিত হলে তা ছড়িয়ে যায় যে কোনো ভাইরাসের চেয়ে দ্রুত গতিতে, বিশেষ করে এই সামাজিক মাধ্যমের যুগে৷ তা ক্ষতি করে মানসিক স্বাস্থ্যের৷ অথচ প্রয়োজন উলটোটার৷ কভিড-১৯ এর মত ভাইরাস ঠেকাতে প্রতিষেধক লাগে না৷ শুধু শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই একে ঠেকিয়ে দেয়া যায়৷ কিন্তু তার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যও সবল থাকতে হবে৷ তা না হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকবে না৷ চীনে সবাই মিলে ঠেকিয়ে দিয়েছে নতুন এই ভাইরাসটিকে৷ আমাদেরও ঠেকাতে হবে৷ এটি একদিনেই চলে যাবে না৷ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো থেকে যাবে৷ তাই আমরা যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা নিয়ে আতঙ্কিত নই, তেমনি আসুন এটি নিয়েও আতঙ্কিত না হই৷ শুধু একটু বাড়তি সতর্ক হই৷ জীবনাভ্যাস পরিবর্তন করি৷ তবেই হবে জয়, আবারো!