করোনা ভ্যাকসিনের ভূরাজনীতি
৮ জানুয়ারি ২০২১কোভিড নাইনটিনের টিকা আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় আগের শতকের একাত্তর সালের মেরুকরণ যেনবা কূটনীতির অঙ্গনে৷ বাংলাদেশের পাশে ভারত৷ পাকিস্তানের পাশে চীন৷ ঢাকা টিকা কিনছে দিল্লি থেকে আর ইসলামাবাদ বেইজিং থেকে৷ উপমহাদেশের কূটনীতির এই অর্ধ শতাব্দের চিত্র উল্টে দেয়ার মতোই ঘোষণা দিয়েছিলেন সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা৷ ৩ জানুয়ারি রোববার তিনি বার্তাসংস্থা এপির কাছে বলেছিলেন, ভ্যাকসিন রপ্তানিতে ভারত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷
এই খবরে বাংলাদেশে অনেকটা বিনামেঘে বজ্রপাত পরিস্থিতি তৈরি হয়৷ ফেসবুকের মতো সমাজমাধ্যমে ফেটে পড়ে ঢাকার সুশীল সমাজ৷ ভ্যাকসিন নিয়ে ভারতনির্ভরতা হয় প্রশ্নবিদ্ধ৷ আসে তিস্তার পানি, পেঁয়াজ আর ইলিশের মতো পণ্যে ঢাকা-দিল্লি-কলকাতার নানা টানাপড়েনের প্রসঙ্গ৷ এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল বাংলাদেশের সরকারের ভেতরেও৷ ৪ জানুয়ারি সোমবার জরুরি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক৷ ‘সুসংবাদ আছে’- সেই বৈঠকেই জানান স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান৷ তার দাবি ছিল, ঢাকার ভারতের উপ হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন৷ এভাবে নিশ্চিত হয়েছেন ভারতের নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেই বাংলাদেশ৷
এদিকে একই দিন বিকেলে দীর্ঘ সময় ধরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল হাসান পাপন, কেননা, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার করোনা ভাইরাসের টিকা ভারতের সেরামের থেকে বাংলাদেশের হয়ে আমদানি করবে তারা৷ নাজমুল হাসান পাপনের ভাষ্যমতে, সরকারের অনুমোদন পেলে মাসখানেকের মধ্যে টিকা চলে আসবে৷
সেই ৪ জানুয়ারি সন্ধের মধ্যেই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনাপত্তি সনদ (এনওসি) দিয়ে দেয় বেক্সিমকোকে৷ এতে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকেই আসবে টিকা- এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে আসলে তখনো পারছিল না বাংলাদেশি জনতা৷ কারণ, যেখানে দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রীর তথা শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক ভার্চুয়াল বৈঠকে ভ্যাকসিন নিয়ে যুথবদ্ধ থাকার ইঙ্গিত দেয়া হয়, তারপর আবার আসে নিষেধাজ্ঞার বার্তা, সেখানে আশ্বস্ত হওয়া ছিল কঠিন ব্যাপার৷ অবশ্য পরদিন ৫ জানুয়ারি মঙ্গলবারই এসেছে আশাজাগানিয়া খবর৷ খোদ সেরামের সেই সিইও আদর পুনাওয়ালা টুইট মারফত জানিয়েছেন, ভারত থেকে তাদের টিকা রপ্তানির অনুমোদন বহাল৷
করোনার টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে মঙ্গলবার ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দিল্লিতে যে সংবাদ সম্মেলন করেছে, সেখানেও স্বাস্থ্য সচিব রাজেশ ভূষন নিশ্চিত করেছেন নিষেধাজ্ঞার কোনো বালাই নেই৷ দিল্লির টিকা ঢাকা পাবে- এ ভরসা আপাতত করাই যায়৷
তবু একমুখী টিকানীতি কতটা গ্রহণযোগ্য? যেখানে আগাম ঘোষণা ছাড়া পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত৷ সীমানা পার হতে দেয় না গরু৷ বছর কয়েক আগে সব ঠিক থাকার পরও তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি থেকে শেষ সময়ে সরে আসে দিল্লি৷ ভ্যাকসিনে ঢাকার জন্য বিকল্প পথ রাখা তাই প্রয়োজন ছিল৷ সেই পথ আসলে কী হতে পারে? সুদূর পশ্চিম থেকে আনলে খরচে কুলোবে না৷ আবহাওয়ার তারতম্যে টিকা সংরক্ষণেও জটিলতা তৈরি হতে পারে৷ তাই ইউরোপ-আমেরিকার দিকে যাচ্ছে না বাংলাদেশ৷ অন্যদিকে চীন বিভিন্ন সময় আসতে চেয়েছে এখানে৷ তাদের সিনোভ্যাক বায়োটেক বাংলাদেশে ভ্যাকসিন পরখ করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু এর খরচ ঢাকা থেকেই জোগান দিতে হতো৷ তাই রাজি হয়নি সরকার৷
অবশ্য চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান আনুই জিফেইয়ের দেয়া প্রস্তাব বিবেচনায় রাখছে সরকার৷ নিজস্ব খরচেই এই প্রতিষ্ঠান টিকার পরীক্ষা চালাতে চায়৷ ভারত ঝুলিয়ে দিলে চীন থেকে টিকা আহরণ ছাড়া বাংলাদেশের হাতে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান আর মাত্র একটি উপায়৷ সেটা দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্স৷ তবে এর জন্য আরো সময় দিতে হবে৷ কারণ, ৬ জানুয়ারি বুধবার মাত্রই তারা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য ভ্যাকসিন উৎপাদনের অনুমোদন পেয়েছে৷ বঙ্গভ্যাক্স চূড়ান্ত হতে আরো সময় লাগবে৷ এছাড়া বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিষয়ক দাতাগোষ্ঠীর জোট (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস বা গ্যাভি ও কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনসের গড়া প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্স) থেকে টিকা পাবে বাংলাদেশ৷ কিন্তু তার জন্য আরো অন্তত ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে৷ সে পর্যন্ত তাই তাকিয়ে থাকতে হবে ভারতের দিকে৷ নয়তো চীনের দিকে হাত বাড়ানোর সময় বা সামর্থ্য কোনোটা কী হবে বাংলাদেশের? হালের ভূরাজনীতি সে ইঙ্গিত দেয় না৷ কিন্তু রাজনীতিতে আবার শেষ কথা বলে তো কিছু নেই!