করোনা: সরকারের অঙ্গীকার, বাস্তবতা ও অব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই সরকারের নানা অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে৷ অনেক ক্ষেত্রে কথা ও কাজের মিল থাকেনি, কেন কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে সেটি বোঝাও দুরুহ হয়েছে অনেক সময়৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
‘প্রস্তুতির ঘাটতি নেই’
গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে৷ তখন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই৷ অথচ সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে দেশের চিকিৎসা খাতে চরম অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়৷ করোনায় সংক্রমিত ছাড়া অন্য রোগীদেরও চিকিৎসা বঞ্চিত হওয়ার চিত্র উঠে আসে গণমাধ্যমে৷ এমনকি করোনাকালীন চিকিৎসা সরঞ্জামের কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতির খবরও বেরোয়৷
ছুটি ও লকডাউন বিড়ম্বনা
করোনা সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন দেশ যখন লকডাউন আরোপ করে, বাংলাদেশ সেসময় সরকারি ছুটি ঘোষণা করে৷ এতে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা৷ এরপরও কয়েক দফা কখনো বিধিনিষেধ আরোপ, কখনো শিথিলতা চলতে থাকে৷ ‘লকডাউনে’ শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে কিন্তু বন্ধ থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ গণপরিবহন বন্ধ থাকে, চলে ব্যক্তিগত যান৷ ঈদযাত্রায় ফেরিঘাটে পদপৃষ্ঠ হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে৷
‘করোনা দূর হয়ে যাবে’
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে কেনা টিকা দিয়ে সাত ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি চালু করে সরকার৷ সেসময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘‘আমরা আশা করছি করোনা ভাইরাস দূর হয়ে যাবে। ফাইনাল ব্লো-টা আমরা দেবো ভ্যাকসিনের মাধ্যমে৷’’ বাস্তবতা হলো, ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় কয়েক মাসের মধ্যেই টিকা নিয়ে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ৷
দ্বিতীয় ডোজের অনিশ্চয়তা
দুই চালানে ৭০ লাখ ডোজ পাঠানোর পর ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। অন্য কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি না থাকায় ২৫ এপ্রিল দেশে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। যারা কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ নেন তাদের মধ্যে ১৫ লাখ যথাসময়ে দ্বিতীয় ডোজ পাননি৷
‘সব ব্যবস্থা আছে’
করোনা সংক্রমণ বাড়ার প্রেক্ষিতে গত ১১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কথা হয়েছে, তারা যেন তাদের হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখে। হাসপাতালে যে বেড বরাদ্দ ছিল, সেগুলো আবারও প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে৷ এছাড়া চিকিৎসার জন্য যা লাগে, সব ব্যবস্থা করা আছে৷”
তবু আইসিইউ সংকট
বাসস্তবতা হলো, করোনা সংক্রমণ শুরুর দেড় বছর পরও দেশের শতকরা ৫২ ভাগ কোভিড হাসপাতালে আইসিইউ নেই৷ আইসিইউ সুবিধা নেই এমন হাসপাতালের ৩৫টিই আবার ঢাকার বাইরের জেলা সদরগুলোতে৷ এরমধ্যে সারাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় ঢাকার বাইরের জেলা ও গ্রামে করোনা চিকিৎসা নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে৷ কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে অক্সিজেন সংকটে রোগীরা মৃত্যুবরণ করছেন৷
বাজেট ব্যবহারে অক্ষমতা
৯ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, “বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ কম- এটা বাড়াতে হবে। ...যদি আমরা ব্যয় না বাড়াই, লোকবল, যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা না করি, হাসপাতালের ব্যবস্থা না করি, তাহলে কী যে হবে তা করোনা ভাইরাস শিখিয়ে দিয়ে গেল৷’’ বাস্তবতা হলো গত অর্থবছরের বাজেটে এডিপিতে এই খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তার মাত্র ২৫ ভাগ ব্যয় হয়েছে দশ মাসে৷ গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল তা-ও ব্যবহার করা হয়নি৷
গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোয় ব্যর্থতা
শুরুতে করোনা সংক্রমণ শহর পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে৷ এর মধ্যে গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা ও সক্ষমতা গড়ে তুলতে দৃশ্যত তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার৷ ১২ জুলাই উল্টো স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘গ্রামের মানুষের ধারণা ছিল, তাদের করোনা হবে না৷ কিন্তু এখন গ্রামের মানুষের করোনা সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি৷’’
মানুষের জীবিকা
করোনা বিধিনিষেধ বা লকডাউনের জেরে বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্র হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জরিপে৷ কিন্তু লকডাউন বা বিধিনিষেধ দেওয়ার আগে নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের কথাও মাথায় রাখা হয় না৷ ১৩ জুলাই নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার পাঁচটি নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও কবে নাগাদ, কিভাবে বিতরণ হবে তা এখনও পরিস্কার নয়৷
কেন কড়াকড়ি, কেন শিথিল
১ জুলাই থেকে বাংলাদেশে কঠোর লকডাউন শুরু হয়৷ সেদিন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল আট হাজারের উপরে, মৃতের সংখ্যা ১৪৩৷ সেটি বেড়ে ১৪ জুলাই আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়েছে, মৃত্যু প্রতিদিন গড়ে ২০০ জনের উপরে৷ অথচ ঈদের কারণে বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ করোনা ভাইরাসে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার যখন বেড়ে চলেছে, তখন বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ায় বিশেষজ্ঞরাও বিস্মিত, উদ্বিগ্ন৷