করোনার আবহে বাড়বাড়ন্ত প্রতারণায়
৬ আগস্ট ২০২০ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে দীর্ঘ লকডাউন ও তারপর আনলক-এর সময় সাধারণ মানুষের গতিবিধি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত৷ সেই কারণে বিভিন্ন প্রয়োজনে অনলাইন সংস্থার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে৷ এই সুযোগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কেনাবেচায় প্রতারণা চক্রের জাল আরো বিস্তৃত হচ্ছে৷ সম্প্রতি কলকাতায় এমন একাধিক ঘটনা সামনে এসেছে যা চমকে দেওয়ার মতো৷
লকডাউনের সময় বিভিন্ন ধর্মস্থল বন্ধ ছিল৷ সরকারি নির্দেশে পরে তা খুলে গেলেও অনেক পুণ্যার্থী সেখানে সশরীরে হাজির হতে পারছেন না যাতায়াতে সমস্যা বা স্বাস্থ্যের কারণে৷ এতে হাতে চাঁদ পেয়েছে অনলাইন প্রতারকেরা৷ পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত মন্দিরগুলি ইতিমধ্যে খুলে গেলেও ভক্তদের আগমন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে৷ এর ফলে কলকাতার কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর এবং বীরভূমের তারাপীঠের মন্দিরে পূজা দেওয়ার জন্য অনলাইনের হাতছানি রয়েছে৷ অথচ এগুলি মন্দির কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ওয়েবসাইট নয়৷ এই ওয়েবসাইটে ঢুকলে আপনি দেখতে পাবেন, কম থেকে বেশি টাকা মূল্যের নানা প্রণামীতে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে৷ পছন্দের পূজার মূল্য আগাম চুকিয়ে দিলেই তা নিবেদিত হবে দেবীর চরণে৷ এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অনলাইন প্রতারকেরা৷ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ নিজেদের গাঁটের কড়ি খসাচ্ছেন৷ আগামী ১৮ আগস্ট কৌশিকী অমাবস্যায় তারাপীঠে ধূমধাম করে পুজো হয়৷ ইতিমধ্যে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সেই অনলাইন পুজোর বুকিং শুরু হয়ে গিয়েছে৷ সেখানে সশরীরে হাজির থাকতে অসমর্থ প্রবীণরা পুজো দেওয়ার জন্য ইন্টারনেট ঘাঁটছেন৷ বেলঘরিয়ার বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ বিবেক হাজরা বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে বেরোতে পারছি না৷ কোনো সংস্থা যদি অনলাইন পূজা বা প্রসাদের কথা বলে, সুবিধা হয়৷ আমরা প্রতারণার কি বুঝব, প্রশাসন একটু দায়িত্ব নিলে ভালো হয়৷’’ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ উঠেছে, পুরো টাকাটাই চলে যাচ্ছে দুষ্কৃতীদের পকেটে৷ মন্দিরে কিছুই পৌঁছচ্ছে না৷ কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর ও তারাপীঠে প্রতিদিন দীর্ঘ লাইন পড়ে পূজা দেওয়ার জন্য৷ এই তিন মন্দির কর্তৃপক্ষ কিন্তু বলছেন, তাঁরা কোনো ওয়েবসাইটকে অনলাইনে পুজো গ্রহণের অনুমতি দেননি৷
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, বদ্রীনাথের মতো ভারতবিখ্যাত মন্দিরেও পূজা দেওয়ার জন্য অনলাইনে হাতছানি রয়েছে৷ এছাড়া আসন্ন দুর্গোৎসবে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে অনলাইনে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিতভাবেই চালু হবে৷ ইন্টারনেটের অরক্ষিত দুনিয়ায় ঘাপটি মেরে থাকা প্রতারকরা যাতে পকেট কাটতে না পারে, সে জন্য সাধারণ মানুষকেও সচেতন থাকতে হবে৷ এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
পুণ্যলোভী মানুষের ক্ষতি এটুকুই, তার অর্থের অপচয় হল৷ কিন্তু এই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে প্রাণও চলে যাচ্ছে৷ অনলাইনে কোভিড পরীক্ষার ফাঁদ পেতেছে প্রতারকরা৷ বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে সোয়াব৷ তারপর রিপোর্টও আসছে৷ কিন্তু আদৌ সোয়াব পরীক্ষা হচ্ছে না৷ ফলে রিপোর্ট হচ্ছে মনগড়া৷ এই চক্রের ফাঁদে পড়ে প্রাণ দিতে হয়েছে কলকাতার নেতাজিনগরের এক বাসিন্দাকে৷ ২৫ জুলাই তাঁর নমুনা নেওয়া হয় বাড়ি থেকে৷ কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট দেওয়া হয়৷ ২৯ জুলাই ওই ব্যক্তি গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন৷ পরের দিনই মৃত্যু হয় তাঁর৷ মৃতের স্ত্রী থানায় অভিযোগ দায়ের করলে প্রতারণা চক্রের জাল সামনে আসে৷ গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে৷ শুধু অনলাইন নয়, অফলাইনেও একই ছবি৷ হাসপাতাল কর্মীর পরিচয় দিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার ঘটনা সামনে এসেছে৷ সাড়ে তিন হাজারের বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে পরীক্ষা করানোর জন্য৷ কিন্তু সোয়াব পরীক্ষা করা হচ্ছে না, কাল্পনিক রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে৷ এর ফলে অসুস্থ ব্যক্তি জানতেই পারছেন না, তিনি মারণরোগে আক্রান্ত কি না!
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ-প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হতে হবে বলে মনে করেন প্রাক্তন পুলিশকর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায়৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘সাইবার সেলে প্রচুর অভিযোগ আসে৷ বর্তমান পরিকাঠামোয় একটা কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থায় সবটা দ্রুত সামলানো মুশকিল৷ তাই কয়েকটি জোন ভাগ করে তদন্ত চালাতে হবে৷ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে তদন্তকারীদের৷ আর অবশ্যই অনলাইনে লেনদেন করার আগে যথে্ট সচেতন থাকতে হবে ক্রেতাকে৷’’ তবে জনসচেতনতার থেকে অপরিসিম লোভ নিয়ে চিন্তিত সাহিত্যিক-সম্পাদক জয়ন্ত দে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘লকডাউনে রোজগার নেই বলে প্রতারণা করছে এমন নয়৷ আসলে উদ্বৃত্ত পয়সার দরকার৷ মানুষ লোভের জন্য প্রতারণা করছে৷ এটা নৈতিক অবক্ষয়৷ কাউকে ভুল রিপোর্ট দেওয়া শুধু প্রতারণা নয়, এটা খুনও৷ পুলিশ-প্রশাসনের ঢিলেমিতে প্রতারকদের সুবিধা হচ্ছে৷’’