করোনার প্রভাবে বেহাল ভারতীয় অর্থনীতি
১৮ মার্চ ২০২০সংসদ ভবন চত্বরে সাংবাদিকদের কাছে কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর জানিয়েছেন, দেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব কতটা পড়েছে ও পড়তে পারে, তা নিয়ে সমীক্ষা চলছে। তবে চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। সরকার পরিস্থিতি সামলে নেবে।সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই অর্থ মন্ত্রক, নীতি আয়োগ, তাঁর অর্থনৈতিক পরামর্শদাতাদের করোনা প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সমীক্ষা চলছে, কিন্তু অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞদের ধারণা হল, করোনার প্রতিক্রিয়া দেশের অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতে ভালোভাবেই পড়বে। আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার এক শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। কর আদায় অনেকটাই কমবে। লোকেদের কর্মসংস্থানে আঘাত করবে করোনা। ক্রেতা না থাকায় বাজার মার খাবে। পর্যটন শিল্প, বিমান পরিবহন, রেল প্রচন্ড ক্ষতির মুখে পড়বে। তবে চলতি আর্থিক বছরের শেষভাগে তা বিশেষ বোঝা যাবে না। আগামী ১ এপ্রিল থেকে যে নতুন আর্থিক বছর শুরু হতে যাচ্ছে, করোনার প্রভাব সেখানে রীতিমতো টের পাওয়া যাবে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস বলেছেন, ''বিশ্বের অন্য জায়গার তুলনায় ভারতে প্রভাব অনেক কম হবে। কিন্তু যেহেতু ভারতের অর্থনীতিও বিশ্বের অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত তাই প্রভাব কিছুটা পড়বে।'' কিন্তু সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস বা সিবিডিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''করোনার ধাক্কায় জিএসটি কমতে বাধ্য। কারণ, আর্থিক কাজকারবার কমে গেলে পণ্য ও পরিষেবা দুইটি ক্ষেত্রই মার খেতে বাধ্য। লোকে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া অন্য কোনও জিনিস কিনছে না। ফলে জিএসটি মার খেতে বাধ্য। সেই সঙ্গে কাস্টমসও কমবে, কারণ, আমদানি কমে যাচ্ছে। আর লোকেদের আয় কমে গেলে পরের বছর আয়করও কমবে। প্রশ্ন হল, সরকার আয় বাড়াবে কী করে? 'বিবাদ সে বিশ্বাস' বলে একটা প্রকল্প চালু করেছে সরকার। যদি আয়কর নিয়ে বিবাদ থাকে বা যদি কেউ কর না দিয়ে থাকে, তা হলে সেটা সরকারকে জানিয়ে কর দিয়ে দিলে, আর জরিমানা দিতে হবে না। সরকারের আশা, এর থেকে বড় অঙ্কের টাকা সরকারের হাতে আসবে।''
কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে পেট্রোল-ডিজেলের ওপর শুল্ক লিটারপ্রতি ৩ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর থেকে পাওয়া যাবে ৪০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তা দিয়ে কি পরিস্থিতি সামলানো যাবে। নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের বিজনেস এডিটর জয়ন্ত রায়চৌধুরি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''রাজস্ব দফতরের আধিকারিকরা বলছেন, পরিষেবা ক্ষেত্রে প্রবল ক্ষতি হবে। উৎপাদন ক্ষেত্র বিপুল ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই জিএসটি এবং কর আদায় মার খেতে বাধ্য। সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থার শেয়ার বিক্রি করে ২ লাখ দশ হাজার কোটি টাকা তোলার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু এই বাজারে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই প্রাক্তন অর্থ সচিব এস সি গর্গ মনে করছেন, পেট্রো পদার্থের ওপর শুল্ক বাড়াবার পরেও সরকার ক্ষতির সামাল দিতে পারবে না। আর অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব বোঝা যাবে আগামী আর্থিক বছরের প্রথম বা বলা ভালো দ্বিতীয় কোয়ার্টারে।''
করোনার প্রভাব যে সব ক্ষেত্রে পড়ছে, তার মধ্যে অন্যতম হল বিমান চলাচল। বোর্ড অফ এয়ারলাইন রিপ্রেজেন্টেটিভস ইন ইন্ডিয়া(বিএএলআর) অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রককে একটা চিঠি দিয়েছে। তাদের দাবি, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার যেন বিমান পরিষেবা ব্যবহারের জন্য দেয় অর্থ তিরিশ শতাংশ কম করে দেয়। তারা জানিয়েছে, প্রচুর ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। বিমানে যাত্রী কমে গিয়েছে। বিদেশ থেকে কেউ আসতে পারছেন না। ফলে বিমান চালিয়ে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। বিমান সংস্থাগুলির প্রস্তাব, তারা কিছু কর্মীকে বিনা বেতনে বাড়িতে থাকতে বলবে। রোটেশন পদ্ধতিও চালু করা হচ্ছে। মানে কর্মীরা পালা করে কাজ করবেন।
করোনার প্রভাবে ভারতের আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে বিশ্বের অন্যতম প্রধান রেটিং সংস্থা মুডি। তারা বলেছে, আগামী আর্থিক বছরে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ নয় বরং প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হারে। তার মানে বর্তমান বছরের মতোই আর্থিক প্রবৃদ্ধি হবে বলে মনে করছে তারা। প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে না। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবৃদ্ধির হার ০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ কমতে পারে। তবে অর্থ মন্ত্রকের আধিকারিকরা এই যুক্তি মানতে চাইছেন না। প্রবীণ সাংবাদিক জোসেফ ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''আমি সম্প্রতি আর্থিক উপদেষ্টা কে সুব্রমণিয়ামের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তিনি বলেছেন, করোনার প্রভাব যে অর্থনীতিতে পড়বে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সেটা ভয়ঙ্কর কিছু হবে না। কারণ, করোনার প্রভাব চলে গেলেই আমাদের শিল্প আবার ফুলে ফেঁপে উঠবে। তখন চাহিদা বাড়বে। এটাকে বলা যেতে পারে সাময়িকভাবে থমকে যাওয়া। ফলে করোনার প্রভাব আগামী মাস কয়েকের মধ্যে কেটে গেলে, ধাক্কা সামলে নেওয়া যাবে বলে তাঁরা মনে করছেন।''
সেটা এত সহজে হবে কি না, তা এখনই বলতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। সুমিত দত্ত মজুমদার যেমন বলছেন, এখন প্রধান কাজ হল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান চালু রাখা। এটা সরকারকে দেখতে হবে। দ্বিতীয় কথা হল, লোকে ভয়ে নিজেদের ঘরবন্দি করে ফেলছেন। ফলে দোকানে বাজারে ভিড় নেই। অনলাইনে বেশি কেনাকাটা হচ্ছে। রেস্তোরাঁ, ফাস্ট ফুড জয়েন্ট, মাছ ও সবজি বিক্রেতাদের বিক্রি পঞ্চাশ থেকে ৮০ শতাংশ কমে গিয়েছে। কিন্তু এই প্রবণতা আরও বাড়লে দিন আনি দিন খাই মানুষেরা বিপাকে পড়বেন। ইতিমধ্যে সব চেয়ে মার খাচ্ছে পর্যটন। রাজস্থানে সরিস্কায় রিসর্ট চালান শুভম। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, এই সময় তাঁর রিসর্ট ভর্তি থাকে। এখন লোক নেই। তাজমহল থেকে শুরু করে সব মনুমেন্টের গেটে তালা পড়ে গিয়েছে। লোকে যাবে কোথায়? জয়ন্তর মতে, ''এই সবেরই প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। তার ওপর আগামী দিনের কথা ভেবে লোকে খরচ করতে ভয় পাচ্ছে। করোনা ভাইরাসের প্রকোপ থামলে বোঝা যাবে, দেশের অর্থনীতির হাল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তবে করোনার আঘাত যে ভালোভাবে পড়বে তা বোঝা যাচ্ছে। এমনিতেই অর্থনীতির হাল ভালো ছিল না। তার ওপর করোনার প্রহার যুক্ত হল।''