করোনায় ভয়াবহ পরোক্ষ মৃত্যু
২৫ ডিসেম্বর ২০২০করোনার প্রত্যক্ষ দায়টা বোঝাই যাচ্ছে৷ করোনা বয়স্কদের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে৷ যাদের হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা অন্য জটিল রোগ রয়েছে, তারাও করোনার প্রথম শিকার৷ কিন্তু করোনা পরোক্ষ যে প্রভাব ফেলছে, তাতেও মৃত্যু কম ঘটেনি৷
বর্ণভেদে মৃত্যুহারেও তফাত
করোনায় কে কেমন ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তার সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িত অর্থনীতি৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরা যাক৷ দেশটিতে এবার গত পাঁচ বছরের গড়ের তুলনায় তিন লাখ বেশি মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ এর বড় একটা অংশের জন্যই করোনা ভাইরাস দায়ী৷
কিন্তু এই দেশটিতেও করোনা সবাইকে সমানভাবে আক্রান্ত করেনি৷ বয়স্করা বেশি ঝুঁকিতে থাকলেও দেশটির একেক জাতির মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়েছে একেকরকম৷
মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল জানাচ্ছে, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় ল্যাটিনো এবং কৃষ্ণাঙ্গদের করোনায় মৃত্যু হয়েছে দুই দশমিক আট গুণ বেশি৷ অ্যামেরিকান ইন্ডিয়ান ও আলাস্কান নেটিভদের মধ্যে মৃত্যু দুই দশমিক ছয় গুণ বেশি, এশিয়ানদের ক্ষেত্রে এটি এক দশমিক এক গুণ বেশি৷
এর কারণ কী! যদিও এখনও এ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি, বিশেষজ্ঞরা প্রাথমিকভাবে তিনটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন৷ প্রথমত, ল্যাটিনো, কৃষ্ণাঙ্গ এবং এশিয়ানদের বেশিরভাগই অ্যামেরিকায় ছোটখাট কাজের সঙ্গে জড়িত৷ ফলে আয় সীমিত হওয়ায় খরচ বাঁচাতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাও অনেকেই করান না৷ ফলে আগে থেকেই অনেকের শরীরে নানা জটিল রোগ বাসা বেঁধে থাকতে পারে৷ এমনকি অনেকেই করোনার লক্ষণ দেখা দিলেও কাজ হারানো এবং চিকিৎসা খরচের ভয়ে তা লুকিয়ে রেখেছেন বলেও নানা সময়ে জানা গেছে৷
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবে কম স্বচ্ছল হওয়ায় তারা অনেকেই গাদাগাদি করে এবং তুলনামূলক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করেন৷ ফলে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিও অন্যদের তুলনায় তাদের বেশিই থাকে৷
দ্বিতীয়ত, জরুরি সেবা হিসেবে যেসব কাজকে চিহ্নিত করা হয় সেগুলোতে বেশিরভাগই অশ্বেতাঙ্গ মানুষকে চাকরি করতে দেখা যায়৷ ফলে বাসা বা কর্মক্ষেত্রের বাইরে বেশি বের হওয়ার ফলে ভাইরাসের বেশি ঝুঁকিতেও ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনোরা৷
ভবিষ্যতে বিস্তারিত গবেষণায় হয়তো আমরা আরো তথ্য জানতে পারবো৷
অর্থনীতি, মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা
করোনার ফলে বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্যে পড়েছে ব্যাপক প্রভাব৷ একদিকে লকডাউনের ফলে অনেকে চাকরি হারিয়েছে, ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে৷ অন্যদিকে স্কুল-কলেজ বন্ধ, বাসা থেকে বের হওয়ায় নিষেধাজ্ঞার কারণে, মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা বেড়েছে কয়েকগুণ৷ পাশাপাশি বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনাও৷
উদাহরণ হিসেবে জাপানের দিকে তাকানো যায়৷ দেশটিতে কেবল অক্টোবরে যে পরিমাণ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন, পুরো বছরে তত মানুষ করোনাতে মারা যাননি৷ কেবল অক্টোবরেই দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান ২,১৫৩ জনের আত্মহত্যার তথ্য জানাচ্ছে৷ নভেম্বর পর্যন্ত করোনায় মৃত্যু ছিল দুই হাজারের একটু বেশি৷
এ ধরনের পরিসংখ্যান এতো দ্রুত বেশিরভাগ দেশই আপডেট করে না৷ ফলে সার্বিক চিত্র জানা সম্ভব হয় না৷ কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরু থেকেই করোনার মানসিক প্রভাব নিয়ে সবাইকে সতর্ক করে আসছে৷ ফলে জাপানের এই উদাহরণ দিয়ে অন্যান্য দেশের অবস্থাও অনেকটাই বোঝা সম্ভব৷
জাপানে এমনিতেও আত্মহত্যার হার অন্য অনেক দেশের চেয়ে বেশি৷ দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, স্কুলে পড়াশোনার চাপ, সামাজিক একাকিত্ব এবং সাংস্কৃতিক চাপ ইত্যাদি নানা কারণকে অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷
কিন্তু সরকারের ব্যাপক উদ্যোগের ফলে গত ১০ বছর ধরে এই হার ধীরে ধীরে কমছিলো৷ করোনার ফলে আবার তা বাড়তে শুরু করায় দেশটির সরকারও ব্যাপক উদ্বিগ্ন৷
এখানেও মূল কারণটা অর্থনৈতিক৷ দীর্ঘদিন অনেকে পরিশ্রম করে দারিদ্র্য থেকে উঠে এসেছিলেন৷ কিন্তু করোনার ফলে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পর্যটনের মতো ক্ষেত্রেগুলো বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অনেকেই আবার দারিদ্র্যে ফিরে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন৷ এসব কাজে নারীদের পার্টটাইম চাকরি বেশি হওয়ায় নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি দেখা গেছে৷
নারীর প্রতি সহিংসতা
করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই জাতিসংঘ হুঁশিয়ার করে আসছে নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে৷ অর্থনৈতিক চাপ, মানসিক স্বাস্থ্য, সব মিলিয়ে পরিবারগুলোতে নারীরাই হয়েছেন করোনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার৷ বাড়তে থাকা এই সহিংসতাকে ইউএনওমেন শ্যাডো প্যানডেমিক বা ছায়া মহামারি হিসেবেও বর্ণনা করেছে৷
কেবল এশিয়া-আফ্রিকার দরিদ্র দেশ নয়, ইউরোপ-অ্যামেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার মত শক্তিশালী অর্থনীতির দেশেও ২০২০ সালে ভয়াবহ আকারে বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা৷ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, প্রতি ঘণ্টায় বিশ্বজুড়ে ছয় জন নারী তার পার্টনার বা পরিবারের সদস্যের হাতে খুন হন৷ যুক্তরাজ্যে প্রতি তিন দিনে একজন নারী খুন হচ্ছেন পরিবারের সদস্যদের হাতে৷
করোনা শুরু আগেই এ পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ৷ করোনার ফলে তা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে৷
এছাড়া শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে করোনা যে প্রভাব ফেলছে, তাতে শিশু ও তরুণরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলেও নানা সময়েই জানিয়েছে জাতিসংঘসহ অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো৷ অর্থনীতির ধাক্কা দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে করোনার ধাক্কা একটি প্রজন্মকেই হুমকিতে ফেলবে, এমন আশঙ্কা তো থাকছেই৷