কলকাতার রাস্তায় ক্রিসমাস কার্নিভাল
২৫ ডিসেম্বর ২০১৪‘‘এটা পুজোর থেকে ভালো, তাই না মা?'' রঙীন টুপি আর চারদিকে ঝিকমিকে আলো জ্বলা চশমা পরে মায়ের হাত ধরে ভিড়ে ঠাসা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল ছোট্ট একটা মেয়ে৷
তার এই ফূর্তির অবশ্যই কারণ আছে৷ পুজোর সময়ও নতুন জামা পরে ঠাকুর দেখতে বেরনো হয়, কিন্তু কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের এই ক্রিসমাস সমারোহের সঙ্গে সত্যিই কোথাও কার্নিভালের ফূর্তিবাজ মেজাজের একটা মিল রয়েছে৷ নানা ধাঁচের নানা রঙের টুপি, উজ্জ্বল গোলাপি, কমলা কিংবা নীল রঙের নকল চুল, মজাদার মুখোশ, জোড়া হৃদয় থেকে শুরু করে ঝিকমিকে তারার আকারের চশমা, তার মধ্যে আবার আলো জ্বলে – এমন মজার সাজগোজ করার সুযোগ পুজোর সময় আর কোথায়!
আসলে কলকাতার ‘কসমোপলিটান' চরিত্রের সঙ্গে তাল রেখেই সমস্ত সম্প্রদায়ের লোক আজকাল সামিল হচ্ছেন ক্রিসমাস বা বড়দিন কেন্দ্রিক এই কার্নিভালে৷ বিশেষত হিন্দি ভাষাভাষী মানুষ যেভাবে সপরিবারে, দলে দলে মেতেছিলেন আনন্দে, সেটা ছিল দেখার মতো৷ আর হুজুগে বাঙালি তো ছিলই৷ ব্যস্ত পার্ক স্ট্রিটের যান চলাচল স্বাভাবিক রেখে এই জনজোয়ারের ঢেউ সামাল দেওয়াটা শুধু পুলিশের বাড়তি দায়িত্ব হয়েছিল, যে কাজ তাঁরা সফল ভাবেই সামলেছেন৷
গোটা পার্ক স্ট্রিট যথারীতি সেজেছিল রঙীন আলোর মালায়৷ সান্তা ক্লস (বানানভেদে সান্তা বা স্যান্টা ক্লজ), বরফের পুতুল, রেন ডিয়ার আঁকা হয়েছিল আলো দিয়ে৷ আর আলো জ্বলেছিল আনন্দে মাতোয়ারা হাজার হাজার শিশু মুখে৷ কলকাতায় ক্রিসমাসের সাজসজ্জা যথেষ্ট থাকলেও উৎসবে সরাসরি অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না৷ পার্ক স্ট্রিট কার্নিভাল সেই সুযোগ এনে দিয়েছে বিশেষ করে কচিকাঁচাদের জন্যে৷
এছাড়া বড়দের জন্য পার্ক স্ট্রিট কার্নিভালের সবথেকে বড় আকর্ষণ বোধহয় নানা দেশের, নানা স্বাদের মনমাতানো সুখাদ্যের পশরা৷ পার্ক স্ট্রিটের ওপর যত নামজাদা রেস্তোরাঁ, বেকারি আর ফাস্ট ফুডের দোকান আছে, তারা প্রায় সবাই ‘ফুড স্টল' দেয় এই পার্বনে৷ ফলে পাঁচ তারা হোটেলের যে সুখাদ্য খেতে গেলে অনেক বেশি পয়সা খরচ করতে হয়, সেই খাবারই চটজলদি, হাতে গরম পাওয়া যায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে৷ যে বিখ্যাত বেকারিতে বসার জায়গা পাওয়া যায় না, তাদের কেক-পেস্ট্রিও পাওয়া যায় উচিত দামে৷
আরও একটা জিনিস প্রতি বছরই চোখে পড়ে, এ বছরও তার কোনো ব্যাতিক্রম হয়নি, বহু চীনা পরিবার ঘরে বানানো খাবারের স্টল দেন পার্ক স্ট্রিট কার্নিভালে৷ ফলে সাহেবি পেস্ট্রির পাশেই যেমন বাঙালির নিজস্ব পাটিসাপ্টার দোকান, তেমনই চীনাদের ঘরোয়া ফিশ বল সুপ আর চিকেন ডাম্পলিংয়ের আয়োজন৷ কার্নিভালের সবথেকে বেশি ভিড় সম্ভবত এই স্টলগুলোর পাশেই ছিল, যেখানে বল্গা হরিনের শিং অথবা মিকি মাউসের কান লাগানো টুপি পরা ক্ষুদেদের পাশাপাশি বড়রাও সমান আনন্দে পেটপুজো করেছেন৷
আর মূল উৎসবের মঞ্চ ঘিরেও মানুষের আনন্দমেলা জমে উঠেছিল যথারীতি৷ একদিকে যীশুখ্রিষ্টের কাহিনি অনুসরণে পুতুল দিয়ে সাজানো দৃশ্য, অন্যদিকে রাজ্য পর্যটন দপ্তরের অনুসন্ধান কেন্দ্র এবং আরও কিছু খাবারের স্টল, আর মাঝখানে সুসজ্জিত মঞ্চে দিনভর নানা ধরনের অনুষ্ঠান, যার মধ্যে অবশ্যই বড়দিনের প্রার্থনা সংগীত বা ক্রিসমাস ক্যারল৷
লোকে যেভাবে ভিড় জমিয়ে সেই বৃন্দগান শুনছিলেন, যেভাবে তাঁরা জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে আনন্দ ভাগ করে নিচ্ছিলেন, তাতে যেন বার বার প্রমাণ হচ্ছিল, ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদ করেন কেবল ধর্ম-ব্যবসায়ীরা৷ যাঁরা ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন৷ তার বাইরে, উৎসবের, উদযাপনের কোনো রঙ হয় না, ধর্মও হয় না৷ এই পার্ক স্ট্রিট কার্নিভালেই যেমন বহু শিখ পরিবারকে চোখে পড়ল, অনুষ্ঠানের মঞ্চে দেখা গেল অনেক মুসলিম তরুণকে গান গাইতে৷ বহু মাড়োয়ারি, গুজরাটি পরিবার সবান্ধবে, সপরিবারে অংশ নিয়েছিলেন হাসি-মজায়৷ মনে হচ্ছিল, আদতেই এই কার্নিভাল এক প্রাণের উৎসব, মানুষের উৎসব৷