উগ্র হিন্দুত্বের জবাবে মঙ্গলযাত্রা
১৪ এপ্রিল ২০১৭কলকাতা, তথা পশ্চিমবঙ্গে কট্টর দক্ষিণপন্থি, হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তির ক্রমশ উত্থান ঘটছে৷ এই ব্যাপারটা রাজ্যের রাজনৈতিক মহলও আর অস্বীকার করতে পারবে না৷ হাতের কাছেই উদাহরণ কাঁথি উপনির্বাচনের ফলাফল৷ সদ্য হওয়া এই নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী জয়ী হলেও প্রচুর ভোট পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছেন৷ এবং ভোট কমেছে বাম প্রার্থীর৷ এই প্রথম নয়, কাঁথিতে এর আগের তিনটি নির্বাচনেই দেখা যাচ্ছে ভোট কমছে বাম প্রার্থীদের, ভোট বাড়ছে বিজেপির৷ এই পরিস্থিতিতে যেখানে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং প্রখর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ পশ্চিমবঙ্গে প্রচার এবং প্রভাব বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে, তেড়েফুঁড়ে উঠেছে রাজ্য বিজেপি, সম্প্রতি রাজ্যে তথাকথিত গো-বলয়ের ধর্মীয় সংস্কৃতি রামনবমী পালনের ধূম পড়েছে, রীতিমতো সন্ত্রস্ত বোধ করছেন পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ৷ রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির রামনবমীর পাল্টা হনুমান জয়ন্তী পালনের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা তারা আরও এক ভুল পথ বলে মনে করছেন৷ বরং তাঁদের মনে হচ্ছে, বাঙালির নিজস্ব যে সংস্কৃতি, যা ধর্মনিরপেক্ষ এবং সর্বজনীন, তাই এবার পালন করতে হবে প্রকাশ্যে, ধর্মীয় রাজনীতির পাল্টা হিসেবে৷
সেই কারণে এবার খাস কলকাতা শহরে, ১৫ এপ্রিল, পয়লা বৈশাখের দিন তিনটি মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে, যেমনটা হয় প্রতিবছর ঢাকায়৷ এই তিনটি শোভাযাত্রার মধ্যে একটি অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে ‘বাংলা ভাষা প্রসার ও চেতনা সমিতি'-র উদ্যোগে৷ কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের লাগোয়া রাজ্য চারু ও কারু মহাবিদ্যালয় থেকে একটি শোভাযাত্রা পয়লা বৈশাখ সকালে যাবে রবীন্দ্র সদন প্রাঙ্গন পর্যন্ত৷ সেখানে মেলা বসবে৷ বাংলাদেশের অনুকরণে ব্যবস্থা থাকবে পান্তাভাত, নোনা ইলিশ আর শুঁটকি মাছের৷ বাংলা পত্র-পত্রিকা বিক্রি হবে৷ দিনভর হবে বাংলা কবিতা পাঠ, বাংলা গান৷ এদিন সকালের আরেকটি শোভাযাত্রা হবে যাদবপুরে, যার গন্তব্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়৷ বেশ কিছুদিন ধরেই বিজেপির ছাত্র সংগঠন ‘অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ'-এর নজর পড়েছে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র বলে পরিচিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ সম্প্রতি সেখানে বেশ কিছু উপলক্ষ্যে এবিভিপি-র কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে বচসা, এমনকি হাতাহাতিও হয়েছে৷ তাই এবার যাদবপুরেও হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা, কতকটা সেই ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা প্রসারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই৷ তৃতীয় আরেকটি শোভাযাত্রা হবে পয়লা বৈশাখের বিকেলে, কলেজ স্ট্রিটে, যার নামকরণ হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবেই ‘পয়লা বৈশাখের জুলুস'৷ সম্ভবত এটা বোঝাতেই যে, বাঙালির প্রাণের উৎসবে ধর্ম বা সাম্প্রদায়িকতার স্থান কোনোদিন ছিল না, এখনও নেই৷
অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক শামিম আহমেদ যোগ দেবেন কলেজ স্ট্রিটের এই জুলুসে৷ তিনি মনে করছেন, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই ধরনের সার্বজনিক উৎসবের আরও বেশি করে প্রয়োজন আছে, যা ধর্ম নিরপেক্ষতার ভাবনাকে আরও মজবুত করবে৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শোভাযাত্রার ক্ষেত্রে যেমন সাজ-সজ্জায় তাতে ইসলামবিরোধিতার অভিযোগ ওঠে, তাকেও অবান্তর মনে করেন শামিম৷ যদিও পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের মঙ্গলযাত্রার কোনো প্রচলন ছিল না, এবং বিষয়টা রাম-নবমীর মতোই নতুন বলে শামিম রসিকতা করলেন, কিন্তু তাঁর জোরদার ধারণা, এমন নতুন জিনিস, যা সকলের জন্যে ভালো, তার আরও উদ্যোগ নেওয়া দরকার আছে৷
তবে পয়লা বৈশাখের উদযাপন একেবারে ছিল না, তাও নয়৷ বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী, গবেষক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা স্রোতা দত্ত জানালেন, এখন যেমন শান্তিনিকেতনে ২৫ বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালিত হয়, ২০ বছর আগেও তেমনটা হতো না৷ গরমের ছুটি পড়ার আগে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখেই শান্তিনিকেতনে ২৫ বৈশাখ পালিত হতো৷ সকালের বিশেষ প্রার্থনার পর আশ্রমের একটা বিশেষ জায়গায় জড়ো হতো সবাই৷ যেখানে নানা মনীষীর লেখা থেকে পাঠ করে শোনাত ছাত্র-ছাত্রীরা৷ বিদেশ থেকে আসা গবেষকরাও নানা বই থেকে পড়ে শোনাতেন৷ দিনের শেষ হতো রবীন্দ্রনাথের কোনও একটি নৃত্যনাট্য অভিনয়ের মধ্য দিয়ে৷ রবীন্দ্রনাথের আমল থেকেই এমনটা হয়ে এসেছে৷ ধর্মের কোনো ছোঁয়াচ ছিল না সেই বর্ষবরণেও৷
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো বন্ধুরা? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷