কলকাতায় বাতিল করতে হবে দেড় হাজার পুরনো বাস, সংকটে পড়তে পারে গণপরিবহন
গ্রিন ট্রাইবুন্যালের নির্দেশ মানতে গেলে কলকাতায় দেড় হাজার বাস বাতিল করতে হবে। তাহলে সংকটে পড়বে গণপরিবহন ব্যবস্থা।
কেন বাতিল করতে হবে পুরনো বাস?
গ্রিন ট্রাইবুালের নির্দেশ মানা হলে কলকাতায় ১৫ বছর বা তার বেশি পুরনো বাস বাতিল করতে হবে। পরিবেশ দূষণ কমাবার জন্যই এই সিদ্ধান্ত। শুধু কলকাতা নয়, সারা ভারতের জন্যই এই নিয়ম চালু করেছে তারা। কয়েকমাসের মধ্যেই কলকাতায় তাদের নির্দেশ মানা হতে পারে। ফলে বাতিল হতে পারে শহরের বহু বাস। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কলকাতার গণপরিবহন ব্যবস্থা ভয়ঙ্কর সমস্যার মুখে পড়তে পারে।
কত বাস বাতিল হতে পারে?
কলকাতা শহরে প্রতিদিন কম-বেশি তিন হাজার পাঁচশ বাস চলাচল করে। গ্রিন ট্রাইবুালের নির্দেশ মানলে আগামী মার্চের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার বাস বাতিল হয়ে যাবে। এক ধাক্কায় এতগুলি বাস বাতিল হলে তার প্রভাব কলকাতার গণপরিবহনের ক্ষেত্রে পড়বে।
বাস ব্যবসায় অনীহা
বাস মালিকদের দাবি, ইতিমধ্যেই যতগুলি পুরনো বাস বাতিল হয়ে গিয়েছে, তার পরিবর্তে ততগুলি নতুন বাস রাস্তায় নামেনি। তেলের দাম বেড়েছে, বিভিন্ন সরকারি নিয়ম আর কোভিডের পরের সময় থেকে বাসযাত্রীর সংখ্যা কমেছে। তাই বাস ব্যবসায় উৎসাহ হারাচ্ছেন তারা।
কেন কমছে বাসযাত্রী?
বাস মালিকদের বক্তব্য, ২০১৮ সালে শেষবার ভাড়া বেড়েছিল, তারপর থেকে আর ভাড়া বাড়েনি। এরকম একটা পরিস্থিতে এই ব্যবসায়ে তাদের অনীহা চলে এসেছে। তা ছাড়া কোভিডের পর বহু নিত্যযাত্রী বাইক অথবা ব্যাটারি চালিত সাইকেল কিনে নিয়েছেন। ফলে বাসযাত্রীর সংখ্যাও অনেকাংশেই কমে গিয়েছে আগের থেকে। তাছাড়া কলকাতার মান্ধাতার আমলের বাসযাত্রা একেবারেই আরামদায়ক নয়। যাত্রী তোলার জন্য বেসরকারি বাসগুলি প্রচুর সময় নষ্ট করে।
নিজেদের মত ভাড়া?
যাত্রীরা জানাচ্ছেন, ২০১৮ সালে যে ভাড়া বেড়েছিল তারপর সরকারি অনুমোদন ছাড়াই বেসরকারি বাস নিজেদের মতো করে ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। বর্তমানে যে ভাড়া নেয়া হয় তা ২০২০ সালের বর্ধিত ভাড়া।
সিন্ডিকেটের বক্তব্য
জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটের সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, কোভিড-এর সময় দুই'বছর বাস চলাচল করেনি। সেই দিক থেকে বিচার করলে দুই বছর অতিরিক্ত সময়ে দেয়া উচিত বাস মালিকদের। যদিও সরকার এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। এই পরিস্থিতি থাকলে নভেম্বর শেষ হতে না হতেই শহরের রাজপথ থেকে উধাও হয়ে যাবে বাস। মুখ্যমন্ত্রী হস্তক্ষেপ দাবি করেছে বাস সিন্ডিকেট।
হাইকোর্ট যা বলেছে
রাজ্য পরিবহণ দফতরের যে নির্দেশিকা রয়েছে, তাতে বাসের বয়স ১৫ বছর হলেই তা বাতিল করতে হবে। সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে যান কলকাতার একটি রুটের বাসমালিকেরা। গত সোমবার সোমবার কলকাতা হাই কোর্ট রাজ্যের দিকে দায় চাপিয়ে জানায়, ১৫ বছরের পুরনো বাস রাস্তায় চলবে কি না, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন রাজ্যের মুখ্যসচিব।
সুযোগসন্ধানী অটো-ট্যাক্সি
কলকাতায় রাতে বাসের সংখ্যা খুবই কমে যায়। কারণ যা-ই থাকুক না কেন, রাতের শহরে বাস না পেয়ে বিপাকে পড়ছেন যাত্রীরা। বিনয় মণ্ডল নামের এক যাত্রী বললেন, বেসরকারি চাকরিজীবীদের তো আটটা থেকে পাঁচটা ডিউটি নয়। কাজের চাপে প্রতিদিনই অফিস থেকে বের হতে রাত হয়। বাস পেতে খুব সমস্যা হয়। অটোরিক্সা বদলে বদলে বাড়ি ফিরতে হয়। শেয়ার ট্যাক্সিও সুযোগ বুঝে দর হাঁকায়। এই সমস্যা এখন নিত্যরাতের।
কর্মীর অভাব
রাতের শহরে বাসের অভাবের কথা মানছেন মালিকেরাও। তাঁদের দাবি, অতিমারির পর থেকে বাস চালানোর পেশায় আসতে চাইছে না কেউ। তারা জানিয়েছেন, বাসচালক বা কন্ডাক্টরের কাজ করার থেকে অটো-টোটো চালালে অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রমে বেশি আয় করতে পারছেন তারা। তাই কর্মীর অভাবে অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত সংখ্যার ট্রিপও প্রতি রুটের বাসে প্রতিদিন করানো সম্ভব হয় না। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
মাঝপথেই শেষ
যাত্রীদের অভিযোগ, রাতে কখনও সখনও বাস পাওয়া গেলেও তা শেষ গন্তব্য পর্যন্ত যাচ্ছে না। হাওড়া থেকে সল্টলেকের বাস মাঝপথে রাজাবাজারে গ্যারেজ করে দিচ্ছে। সল্টলেকের বাসিন্দাদের রাতে বাড়ি ফেরার সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। সল্টলেকের এক বাসিন্দা হতাশার সুরে বললেন, সল্টলেকে তো সকলের নিজের গাড়ি নেই। আমাদের মতো মধ্যবিত্তেরা কি তাহলে পথেই রাত কাটাবে?
নিরুপায় বাসকর্মীরাও
এক কন্ডাক্টর এই সমস্যার বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে বলেন, “একদমই সত্যি কথা। কিন্তু আমরাও নিরুপায়। সল্টলেকের যাত্রী রাতের বেলায় সারা বাসে একজন কি দুই জন। এবার দুই জনের জন্য রাতে বাস গেলে আমাদের ডিজেল খরচ পোষাবে না।”
অন্ধকার ভবিষ্যৎ
কয়েকমাস পরে তার বাসটাও বাতিল হয়ে যেতে পারে জেনে বাসচালক বিনোদ বললেন, ''কী আর করা যাবে? মালিক যদি নতুন বাস না নামান তাহলে অন্য কিছু করে জীবন চালাতে হবে। পুলিশের অত্যাচার, পাবলিকের গালাগাল খাওয়ার থেকে অন্য কাজ করা অনেক ভাল।''
অন্যান্য শহরের অবস্থা
দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই-সহ দেশের অন্য বড় শহরে গণপরিবহন ব্যবস্থা অনেক ভালো বলে মনে করেন সেই সব শহরে থেকে আসা মানুষরা। কলকাতার মতো একটা শহরে এমন লজঝড়ে বাস কী করে চলে তানিয়েও তারা প্রশ্ন করেন। কলকাতার গণপরিবহন অনেকাংশেই বেসরকারি গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। যেখানে দেশের অন্যান্য বড় শহরে চিত্রটা উল্টো। সরকারি ঝকঝকে ইলেকট্রিক গাড়ি চলে এখন।
আশঙ্কায় মধ্যবিত্ত
এই অবস্থায় শহরের মধ্যবিত্ত মানুষ আশঙ্কায় দিন গুনছেন। কয়েকমাস পর যদি সত্যিই পুরনো বাস শহর থেকে উধাও হয়ে যায় তারা যাতায়াত করবেন কীভাবে? প্রশ্ন হলো, এই সমস্যার সমাধানে কতটা তৎপর প্রশাসন। তাদের কোনো বিস্তারিত পরিকল্পনার কথা এখনো শোনা যায়নি।