কাঠের খেলনার জন্য বিশ্ববিখ্যাত জার্মানির এক গ্রাম
২ এপ্রিল ২০২১জার্মানির পূর্বাঞ্চলে ওর পর্বতশ্রেণির কোলে ছোট্ট গ্রাম হিসেবে সাইফেন কাঠের খেলনার দৌলতে গোটা বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছে৷ জার্মান রূপকথার অনেক চরিত্র সেখানে আকার-আকৃতি পেয়ে থাকে৷
ছোটবেলা থেকেই মিশায়েল হার্ৎসার সাইফেনের কাঠ খোদাই শিল্প পর্যবেক্ষণ করে আসছেন৷ বড়দিনের উৎসবের মেজাজের পেছনে এই গ্রামের অবদান কম নয়৷ যাজক হিসেবে তিনি গ্রামের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলেন, ‘‘আমরা ওর পর্বতশ্রেণির এমন এক জায়গায় থাকি, যেখানে নভেম্বর মাসেও কখনো কুয়াশা ছেয়ে যায়৷ তখন মনমেজাজ খারাপ হয়ে যায়৷ রাতের অন্ধকার দূর করতে তখন উজ্জ্বল মোমদানি অথবা পিরামিড গড়ে তোলা হয়৷’’
সাইফেনে বড়দিন উৎসবের সাজসজ্জা শুধু প্রস্তুত করা হয় না, সেগুলি তৈরিও করা হয়৷ ছোট্ট এই গ্রামে একশো বিশেরও বেশি প্রতিষ্ঠান সেই কাজ করে৷ নয়বার পরিবার এই নিয়ে ছয় প্রজন্ম ধরে কাঠের সামগ্রী তৈরি করে চলেছে৷ ক্রিস্টিয়ান নয়বারের মতে, অপরূপ এই কারুকার্য এক জীবনধারারও প্রতীক বটে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার মতে, মানুষজন শুধু একটা মোমদানি বা পিরামিড কিনতে আসে না, তারা ওর পর্বতশ্রেণির একটা অংশও সঙ্গে নিয়ে যায়৷ মানুষের মনমেজাজ ভালো রাখার ক্ষেত্রে আমরাও যথেষ্ট অবদান রাখি বলে মনে হয়৷’’
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই সাইফেনে খেলনা তৈরির কাজ শুরু হয়৷ আজও অনেক ভালবাসা নিয়ে শিল্পীরা হাতে করে সূক্ষ্ম কাজ করেন৷ নয়বার পরিবারের কর্মশালায় দশ জন কারিগর কাঠ কার্যত জীবন্ত করে তোলেন৷ মোটিফ হিসেবে খনির দৃশ্য বার বার উঠে আসে৷ কখনো খনির শ্রমিক ও দেবদূত, কখনো শুধু লণ্ঠন হাতে শ্রমিকের পতুল দেখা যায়৷
এর পেছনে কারণ রয়েছে৷ কারণ কয়েক শতাব্দী ধরে সাইফেনের কাছে টিনের খনি রয়েছে৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই ওর পর্বতশ্রেণির জীবনযাত্রার সঙ্গে খনির কার্যকলাপ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে৷ মোমদানির ঐতিহ্যও সেই সময় থেকেই চলে আসছে৷ সেই প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ক্রিস্টিয়ান নয়বার বলেন, ‘‘খনির শ্রমিক শেষ শিফটের কাজ শেষ করে বেরিয়ে এসে যখন আবার দিনের আলো দেখেন, তখন তারা খনির প্রবেশপথে লণ্ঠন রেখে দেন৷ সেই রীতি অবলম্বনেই আলঙ্কারিক মোমদানি তৈরি হয়েছে৷ খনির শ্রমিকরা বিপজ্জনক কাজ শেষ করে বেরিয়ে এসে খ্রিস্টমাস উৎসব পালন করতে পেরে খুশি হতেন৷’’
ওর পর্বতমালার কাঠের কাজের অন্যতম জনপ্রিয় মোটিফ হলো সাইফেন গ্রামের গির্জা৷ সেই গির্জা দেখতে প্রতি বছর বিশ্বের অসংখ্য দেশ থেকে পর্যটকরা ভিড় করেন৷ কিন্তু করোনা সংকটের কারণে যাজক হিসেবে মিশায়েল হার্ৎসারকে প্রায় খালি গির্জায় সংগীত পরিবেশন করতে হয়েছে৷ বছরে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটকের কোনো চিহ্নই গ্রামে চোখে পড়ে নি৷
প্রায় সর্বত্রই অঞ্চলের খনির ঐতিহ্যের চিহ্ন চোখে পড়ে৷ খ্রিস্টমাস পিরামিড নামে পরিচিত নাগরদোলার মতো দেখতে কাঠামোও ব্যতিক্রম নয়৷ সাইফেন গ্রামের যাজক মিশায়েল হার্ৎসার বলেন, ‘‘বড় খনিগুলিতে ঘোড়ায় টানা লিফট থাকতো৷ ঘোড়া সেই কাঠামোর চারিদিকে ঘুরে খনির গভীর থেকে শ্রমিক অথবা পানি টেনে তুলতো৷ সম্ভবত সেই কাঠামোই খ্রিস্টমাস পিরামিডের উৎস৷’’
সারা বছর ধরে বড়দিন উৎসব নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও অর্ধচন্দ্রাকার পিরামিডের উপর মোমবাতি জ্বালিয়ে ক্রিস্টিয়ান নয়বারের ঘরোয়া উৎসব শুরু হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘বলতেই হবে, যে আমাদের জন্য এটাই বছরের সবচেয়ে সুন্দর সময়৷ খ্রিস্টমাস মানেই শান্তি, নিজেকে আবিষ্কারের সময়৷ পরের বছরের জন্য শক্তি সংগ্রহেরও সময় বটে৷’’
প্রতি বছরের মতো এবারও খেলনার গ্রাম হিসেবে সাইফেনের বাতি গোটা বিশ্বকে আলোকিত করে তুলেছে৷
হেন্ড্রিক ভেলিং/এসবি