কুর্দ-সংকটের ঢেউ জার্মানিতেও
২ মে ২০১৩স্বাধীন কুর্দিস্তান ও কুর্দদের অধিকার রক্ষার জন্য বহু বছর ধরে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে পিকেকে গোষ্ঠী৷ ইংরেজিতে যাকে বলা হয় কর্দিস্তান ওয়ারকার্স পার্টি৷ জার্মানিতে দলটিকে সন্ত্রাসী দল বলে গণ্য করা হয়৷ সংখ্যার বিচারে পিকেকের ১৩ হাজারের মতো অনুসারী রয়েছে জার্মানিতে৷ বার্লিনের মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গুলিস্তান গ্যুরবাই বলেন ‘‘সংখ্যাটা উপেক্ষা করার নয়৷''
কুর্দ সম্প্রদায়কে স্বদেশে নানা দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়৷ কয়েক দশক তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে চেপে রাখা হয়েছিল৷ কেউ কুর্দি ভাষায় কথা বললে বা বাচ্চার নাম কুর্দি ভাষায় রাখলে তাকে শাস্তি পেতে হতো৷ এমনকি কারাগারেও নিক্ষেপ করা হতো৷ আর নিজ অধিকারের জন্য সোচ্চার হলে তো কথাই নেই, অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যেত৷
বৈষম্যের শিকার
ছোটবেলার বৈষম্যের কথা মনে হলে এখনও ক্ষোভ জেগে ওঠে জার্মানিতে বসবাসরত ইসমাইলের মনে৷ কুর্দ সম্প্রদায়ের মানুষ তিনি৷ তুরস্কের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাড়ির কাছের স্কুলে পড়তেন৷ স্কুলে এলে প্রতিদিন সকালে ছেলে-মেয়েদের শপথ নিতে হতো যে, একজন ভালো তুর্কি হতে হবে তাদের৷ আমরা কুর্দি ভাষায় কথা বললে মারধোর করা হতো৷ ‘‘তখন যদি পিকেকে থাকত তাহলে আমি তাদের সঙ্গে যোগ দিতাম৷ '' বলেন ইসমাইল৷
১৯৮৪ সালে দক্ষিণ তুরস্কে একটি স্বাধীন, সমাজতান্ত্রিক কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পিকেকে লড়াই শুরু করলে তুর্কি সেনাবাহিনী তা কঠোর হাতে দমন করে৷ ইসমাইল তখন জার্মানিতে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত৷ তা নাহলে স্বাধিকারের লড়াইতে যোগ দিতেন৷ জানান ইসমাইল৷ আজ কুর্দ-সমিতির সক্রিয় কর্মী ইসমাইল৷ তুর্কি সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার৷ আয়োজন করেন মিটিং মিছিলের৷
গৃহযুদ্ধ চরমে ওঠে
৯০-এর দশকে স্বাধীন কুর্দিস্তানের জন্য গৃহযুদ্ধ চরমে ওঠে৷ জার্মানিতেও এসে পড়ে এই ঢেউ৷ জার্মানির বড় বড় শহরে বিভিন্ন তুর্কি প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, ট্রাভেল এজেন্সি ইত্যাদিতে আক্রমণ চালানো হয়৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে পিকেকে পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়৷ কিন্তু পিকেকে তার কর্মকাণ্ড বন্ধ করেনি৷ নিজস্ব টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা ও সাংস্কৃতিক সমিতির মাধ্যমে পিকেকে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে৷ খরচ চালানো হয় কুর্দ জনগোষ্ঠীর চাঁদার টাকায় ৷
পিকেকের আয়
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জার্মানিতে পিকেকের আয় কয়েক লক্ষ ইউরো হবে৷ কুর্দদের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা আদায় করা ও গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করার অপবাদ অস্বীকার করেন ইসমাইল৷ তাঁর মতে, কুর্দ সম্প্রদায়ের মানুষরা স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন সাহায্য করতে৷ বার্লিনের পুলিশও জানিয়েছে, গত বছরগুলিতে কুর্দদের কাছ থেক জুলুম করে টাকা আদায় করার প্রবণতা অনেক কমে গেছে৷
পিকেকের এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মুজাফফা আইয়াটা জানান, সহিংসতার পথ পরিহার করার জন্য পিকেকের তরফ থেকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া আছে ৷ ১৯৯০-এর শেষ দিক থেকে এই পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে৷ একটি স্বাধীন কুর্দিস্তানের বদলে তুরস্কের ভেতরে থেকেই কুর্দদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হচ্ছে পিকেকে৷ কেননা গত কয়েক বছর ধরে কুর্দি সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ ইস্তাম্বুল ও তুরস্কের বড় বড় শহরে কাজ খুঁজতে যাচ্ছেন৷ সেক্ষেত্রে কুর্দদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা খুব সহজ নয়৷ এছাড়া তুরস্কের সরকার কুর্দদের ব্যাপারে কিছুটা ছাড়ও দিয়েছে৷ যেমন কুর্দদের জন্য নিজস্ব টিভি প্রোগ্রাম ও ভাষাশিক্ষা স্কুলের অনুমোদন দিয়েছে৷ অন্যদিকে পিকেকেও বুঝতে পেরেছে যে, সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়৷
রাজনৈতিক যুদ্ধ
ইসমাইলের মতে, ‘‘এখন রাজনৈতিক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে৷ পিকেকে ও তুরস্ক সরকারের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ওপর জোর দিতে হবে৷'' তুরস্ক সরকার কুর্দদের অধিকার রক্ষার অনেক দাবি মেনে নেবে বলে অঙ্গীকার করেছে৷ পিকেকেও তাদের নেতা আব্দুল্লাহ ও্যচালানের ডাকে সারা দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ থেকে সরে আসবে জানিয়েছে৷ উল্লেখ্য, পিকেকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ ও্যচালান ১৯৯৯ সাল থেকে তুরস্কের কারাগারে আটক আছেন৷ কারাগারে থেকেই তুরস্ক সরকারের সঙ্গে এই সংকটের ব্যাপারে দরকষাকষি করছেন তিনি৷ মে মাসের প্রথম থেকেই সশস্ত্র কুর্দ গেরিলাদের তুরস্ক থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে৷ যার মাধ্যমে প্রায় তিন দশক ধরে চলা এই সশস্ত্র সংগ্রামের অবসান ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ জার্মানিকেও তখন পিকেকেকে নিষিদ্ধকরণের ব্যাপারে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে৷