কৃষি বিল নিয়ে প্রবল চাপে মোদী সরকার
২২ সেপ্টেম্বর ২০২০কৃষি বিল ধ্বনিভোটে পাস করিয়েও প্রবল চাপেপড়ল নরেন্দ্র মোদী সরকার। পাঞ্জাবে কৃষকরা রাস্তা রোকো (অবরোধ) শুরু করেছেন। হরিয়ানাতেও বিক্ষোভ চলছে। বেঙ্গালুরুতে বিশাল বিক্ষোভ হয়েছে। মহারাষ্ট্রেও কৃষকরা পথে নেমেছেন। সেই সঙ্গে বিক্ষোভ চলছে সংসদে।
অভিনব বিক্ষোভ। ভারতীয় সংসদের ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবার সারা রাত ধরে সংসদ ভবন চত্বরে গান্ধী মূর্তির সামনে বিক্ষোভ দেখালেন আটজন বিরোধী সাংসদ। কৃষি বিল পাস করানোর সময় তাঁরা যে ধরনের বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন তার জেরে তাঁদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। এরপরই তাঁরা বসে পড়েন বিক্ষোভে। গান্ধী মূর্তির পাশের লনে চাদর পেতে, বালিশ ও কম্বল নিয়ে, ফ্যান লাগিয়ে চলে ডেরেক ও ব্রায়েন, সঞ্জয় সিং সহ আট সাংসদের প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদও সরকারের উপর চাপ বাড়ানোর এবং কৃষকদের কাছে বার্তা পৌঁছনোর জন্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের চাপ বেড়েছে আরো দুটি কারণে। রাজ্যসভায় বিরোধী নেতা গুলাম নবি আজাদ জানিয়ে দেন, সবকটি বিরোধী দল অধিবশন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাঁদের তিনটি দাবি মানা না হলে বয়কট চলবে। অন্যতম শর্ত হলো, ফসল সংগ্রহ করার জন্য ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্যের আইনি স্বীকৃতি দিয়ে বিল আনতে হবে এবং বিরোধী সাংসদদের উপর থেকে সাসপেনশন তুলতে হবে। এরপরই বিরোধী সাংসদরা তাঁদের অবস্থান বিক্ষোভ শেষ করেন।
সরকারের চাপে পড়ার আরেকটি বড় কারণ হলো, সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, যে ভাবে ভোটাভুটির দাবি না মেনে বিল পাস করানো হয়েছে, তা অসাংবিধানিক। পিডিটি আচারিয়া বলেছেন, কেউ ভোটাভুটি দাবি করলে বিলের উপর ভোট করতেই হবে। এটাই নিয়ম। কৃষি বিলের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি।
কেন চাপ বাড়ল
আসলে সামনে বিহার ও তারপর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। দুইটিই কৃষিনির্ভর রাজ্য। সেখানে কৃষকরা এই বিল নিয়ে ক্ষুব্ধ হলে বিজেপির ফল খারাপ হতে পারে। ইতিমধ্যেই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের কৃষকরা আন্দোলন শুরু করেছেন। সেই আন্দোলন দেশের অন্যত্র ছড়ালে মোদী বিপাকে পড়বেন। পাঞ্জাবে কৃষকদের মনোভাব বুঝতে পেরেই অকালি নেত্রী হরসিমরত কাউর বাদল মোদী মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছেন।
যে ভাবে বিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে ও পাস করা বিল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তাতে এই চাপ আরো বেড়েছে। সরকার সমঝোতায় এসে বলেছিল, আট সাংসদ যদি ক্ষমা চেয়ে নেন অন্তত দুঃখপ্রকাশ করেন তো সাসপেনশন তুলে নেয়া হবে। সেই দাবি বিরোধীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তৃণমূলের সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন বলেছেন, ''গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে বিজেপি। তার জন্য আমরা কেন ক্ষমা চাইব।''
এই বিলের প্রবল বিরোধিতা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রামের গরিব কৃষকদের মন পেতে উঠেপড়ে লেগেছেন ও সুর চড়াচ্ছেন।
বিল পাস করাবার সময় সভা পরিচালনা করেছিলেন হরিবংশ, যিনি জেডিইউ নেতা। ফলে বিহারেও চাপ বাড়ছে নীতীশের উপর। হরিবংশ পরিস্থিতি সামলাতে বলেছেন, তিনি একদিনের জন্য উপবাস করবেন। এরপর প্রবীণ বিরোধী নেতা শরদ পাওয়ার বলেছেন, তিনিও বিরোধী সাংসদদের সমর্থনে আজ সারাদিন উপবাস করবেন।
তাই কৃষক ও সাধারণ মানুষের মনে ধারণা তৈরির লড়াইয়ে বিরোধীরা একজোট হয়ে ঝাঁপিয়েছেন। ১৮টা বিরোধী দলের নেতা রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছেন, তিনি যেন বিলে সই না করেন।
বিল নিয়ে আপত্তি কীসের
দুইটি বিল রাজ্যসভায় পাস করিয়েছে সরকার। একটা বাকি আছে। কিছু কৃষি পণ্যের মজুত করার উপর একটা সীমা ছিল। কারণ, মনে করা হতো, এই সীমা না থাকলে মজুতদারদের লাভ হবে। এ বার একটি বিলে মোদী সরকার সেই সীমা তুলে নিয়েছে। স্বরাজ পার্টির নেতা যোগেন্দ্র যাদবের ব্যাখ্যা, এর ফলে ব্যবসায়ীরা জিনিস মজুত করতে পারবে। যখন দাম বেশি থাকবে, তখন তারা বেশি লাভ করবে। দাম কম থাকলে তারা জিনিস কিনবে, ফলে কৃষকদের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। আর যে সংস্থা বিদেশে খাদ্যশষ্য রপ্তানি করে, তাদের উপর কখনোই বিধিনিষেধ চাপানো হবে না। ফলে বড় সংস্থা ও কর্পোরেট এর সুবিধা পাবে।
আরেকটি বিলে কৃষকদের চুক্তি চাষের অনুমতি দেয়া হয়েছে। মানে ফসল বোনার আগে কোনো কোম্পানির সঙ্গে কৃষক চুক্তি করে নেবে, ফসল কত টাকায় বেচবে। তৃতীয় বিলে কৃষকদের যে কোনো বাজারে ফসল বেচার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, যতক্ষণ আইন করে ফসলের ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য ঠিক না করা হচ্ছে এবং সেই মূল্য মানতে কোম্পানিগুলিকে বাধ্য না করা হচ্ছে, ততদিন কৃষকদের লাভ তো হবেই না, বরং কষ্ট আরো বাড়তে পারে। আর প্রথমে কৃষকদের বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে কিছু কোম্পানি মনোপলি বা একচেটিয়া ব্যবসা করে নেবে। তারপর দাম একেবারে কমিয়ে দেবে। ফলে কৃষকরা পথে বসতে পারেন। এই আশঙ্কার ফলেই কৃষকরা পথে নামছেন।
জিএইচ/এসজি(রাজ্যসভা টিভি, বিরোধী দলের বিবৃতি)