কেন আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে বাম প্রার্থীদের?
২১ মে ২০২৪কখনো অভিযোগ তাদের পতাকা ছিঁড়ে নেওয়ার, কখনো বা প্রার্থীর গাড়ি লক্ষ করে ইট ছোড়ার। কখনো ভোটের দিনে তাদের কেন্দ্রের বুথে ভুয়া এজেন্ট বসানোর অভিযোগ। এই অভিযোগের তীর শাসক দলের দিকে। তবে কি পশ্চিমবঙ্গের ভোটে বামেরা আবার ফ্যাক্টর হতে চলেছে?
লোকসভা নির্বাচনে পাঁচ দফার ভোট ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে। বাকি রয়েছে আর দুই দফার ভোট। ২৫ মে ও পয়লা জুনের নির্বাচন যে উত্তপ্ত হবে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। শেষ পর্বে যাদবপুর, দমদম লোকসভা কেন্দ্রে ভোট। তার আগে সিপিএম ও তৃণমূলের মধ্যে টানাপোড়েন বাড়ছে।
যাদবপুরে উত্তেজনা
মঙ্গলবার যাদবপুরের বাম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্যের প্রচার গাড়ি লক্ষ করে ইট ছোড়ার অভিযোগ ওঠে। প্রার্থীর উদ্দেশে 'গো ব্যাক' স্লোগান দেয়া হয়। সিপিএমের দাবি, সোমবার রাতে বাম প্রার্থীর ফেস্টুন, ফ্লেক্স ব্যানার ইত্যাদি ছেঁড়া হয়েছে ১০০ নম্বর ওয়ার্ডে। অভিযোগের তীর শাসকদলের দিকেই। প্রতিবাদে মঙ্গলবার নাকতলায় সভার ডাক দিয়েছে সিপিএম।
গত সপ্তাহ থেকেই উত্তেজনার পারদ চড়ছে। শুক্রবার পাটুলিতে সিপিএম কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছিল। এর প্রতিবাদে সৃজন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে পাটুলি থানা ঘেরাও করে বামেরা। সেখানে হাজির হন তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরা। শাসক দলের অভিযোগ সৃজনদের বিরুদ্ধে। এর ফলে থানা চত্বরে উত্তেজনা চরমে ওঠে। যুযুধান দুই পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়।
অন্য কেন্দ্রের ছবি
মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন আগেই হয়ে গিয়েছে। যেখানে প্রার্থী ছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। প্রচারের পাশাপাশি নির্বাচনের দিন খুবই তৎপর ছিলেন তিনি। এমনকি নিজে অভিযান চালিয়ে শাসক দলের ভুয়া এজেন্টকে চিহ্নিত করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন।
গতকাল শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। সেখানকার সিপিএম প্রার্থী দীপ্সিতা ধর দিনভর বিভিন্ন বিধানসভা এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মতো হুগলিতেও তৃণমূলের সংগঠন খুবই শক্তিশালী। শুধু প্রচারে নয়, ভোটের দিনও তৃণমূলের তিনবারের জয়ী সংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দেয়ার চেষ্টা করেছেন তরুণ বাম নেত্রী।
একই কথা বলা যায় দমদমের সুজন চক্রবর্তী ও ডায়মন্ড হারবারের প্রতিকুর রহমান সম্পর্কে। সাবেক সাংসদ সুজন প্রচারে তার প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলের বিদায়ী সংসদ সৌগত রায়কে টেক্কা দিতে না পারলেও, অবশ্যই এগিয়েই রয়েছেন বিজেপি প্রার্থী শীলভদ্র দত্তের থেকে। টেলিভিশনের পরিচিত মুখ সুজন এবার ভোটের অংক পাল্টে দিতে পারেন বলে জল্পনা শোনা যাচ্ছে।
ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে বিরোধীরা দেরিতে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। এখানে লড়বেন বলে হুংকার ছেড়েছিলেন আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী। তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন বিদায়ী সাংসদ, তৃণমূলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নওশাদ লড়াইয়ে নেই। সেই দায়িত্ব সিপিএম তুলে দিয়েছে প্রতীকের হাতে। তৃণমূলের শক্তপোক্ত সংগঠনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, যতটা সম্ভব প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তরুণ সিপিএম নেতা।
জোটের জোর
এই নির্বাচনে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের আসন সমঝোতা হয়েছে। শুধু বোঝাপড়া নয় কার্যত জোট গড়েই লড়ছে দুই দল। তাদের নেতারা বলছেন, এবারের মতো সমন্বয় অতীতের কোনো নির্বাচনে দুই দলের মধ্যে হয়নি। বিশেষত সেলিমের সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে রয়েছেন।
গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দুটি আসনে জিতলেও বামেদের খাতা ছিল শূন্য। বিজেপির আচমকা উত্থান নজর কেড়েছিল। বাম ভোটে নেমেছিল ধস। গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম, কংগ্রেস ও আইএসএফ বোঝাপড়া করে মোট প্রাপ্ত ভোটে বিজেপিকে পিছনে ফেলেছিল। কিন্তু এবার দিল্লির সরকার গড়ার নির্বাচন। আইএসএফ সমঝোতা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। কতটা ভালো ফল করতে পারে বামেরা, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
তবে মুর্শিদাবাদ থেকে যাদবপুর, শ্রীরামপুর হয়ে ডায়মন্ড হারবার, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সিপিএম এবার দৃশ্যমান একটি শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সিপিএমের তরুণ নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় বলেন, "যে কোনো নির্বাচনে বামেরা প্রচারে থাকে। মানুষের ইস্যুকে মিডিয়া প্রচার করে না বলে, টিভি দেখলে মনে হয় বামেরা নেই। রাস্তায় দাঁড়ালে বামেরা সব সময় ভোটে আছে। পাড়ায় আছে, বুথে আছে। সেখানে বিজেপি, তৃণমূল নেই।"
বামের সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গে সাত দফায় ৪২টি কেন্দ্রে ভোট নেয়া হচ্ছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার সহিংসতার ঘটনা কম। প্রচারের ব্যাপ্তি থেকে বুথ পরিচালনা কিংবা নির্বাচন কমিশনে দরবার, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নজর কাড়ছে বামেরা। গতকাল পঞ্চম দফার ভোটে দলগত ভাবে সিপিএম সবচেয়ে বেশি অভিযোগ জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনের কাছে। অভিযোগের সংখ্যা ২৪৫।
সব মিলিয়ে বামেদের অনেকটাই সম্ভাবনা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "বাম কংগ্রেস জোট এবার ২০টি আসনে জোর টক্কর দেবে, ভালো ফল করবে। জাতীয় দল লোকসভা নির্বাচনে বেশি ভোট পায়, কংগ্রেস ও সিপিএম দুটি জাতীয় দল যাদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়েছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে এই জোট তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ দিতে পেরেছিল। তারপর বাম কংগ্রেস জোট করেনি বলে, তাদের সমর্থকদের একাংশ বিজেপির দিকে চলে গিয়েছে।"
করোনা অতিমারির সময় রেড ভলেন্টিয়ার-এর তৎপরতা থেকে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে উঠে আসার ফলে বামেরা উজ্জীবিত হয়েছে বলে মনে করেন মইদুল। তার মতে, "এবার জোটের প্রাপ্ত ভোটের হার নিঃসন্দেহে বাড়বে। মালদহ দক্ষিণ, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদের মতো আসনে জোট জিতেও যেতে পারে। বাকি অনেক আসনে তারা বিজেপিকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে পেতে পারে।"
যদিও প্রচারের জোয়ার দেখে এখনই ফলের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো মন্তব্যে রাজি নন প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "গত লোকসভা ভোটে বাম ও কংগ্রেস মিলিয়ে ১২ শতাংশের মতো ভোট পেয়েছিল। সামগ্রিকভাবে এই ভোট এবার কিছুটা বাড়বে। কোনো কোনো আসনে বেশ ভালো বাড়বে। বামেদের সামনের সারিতে নতুন নেতৃত্ব আসায় মানুষের বিরক্তি অনেকটা কেটেছে। জনতা পছন্দ করে, ঝকঝকে তরুণ প্রার্থীরা ভোটের ময়দানে লড়াই করুন। এর কিছুটা সুফল জোট পেতে পারে।"