1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কেন আমরা ফাঁসি চাই?

আরিফ জেবতিক১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার শাহবাগে লক্ষ মানুষ সমবেত হয়ে যখন ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল, তখনই তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ প্রশ্ন ওঠে ‘মৃত্যুদণ্ডের’ কার্যকাররণ নিয়ে৷

https://p.dw.com/p/1Dg58
Blogger Arif Jebtic
ছবি: Arif Jebtic

বিভিন্ন সময়ে বহু লোক, বিশেষ করে যাঁরা বাংলাদেশি নন, এমন বন্ধুবান্ধব, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের লোকজন একটি জিনিস বোঝার চেষ্টা করেছেন যে কেন বাংলাদেশিরা একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের মতো একটি শাস্তির দাবি করছেন৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তি যখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে জনদাবি গড়ে উঠছে – ব্যাপারটি অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়৷

আমরা কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড চাই – এটা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছেই পরিষ্কার, কিন্তু যাঁরা আমাদের জুতায় পা রেখে ইতিহাসের পথ হেঁটে আসেননি, তাঁদের পক্ষে এটা সহজে বোঝা মুশকিলই বটে৷ আজকের লেখাটিতে তাই দেখার চেষ্টা করব, কেন একটি জাতির বেশিরভাগ মানুষই যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কামনা করে৷

প্রথমেই মনে রাখা ভালো, মত্যুদণ্ড নিয়ে যে জনদাবি গড়ে উঠেছে সেটা কোনো নতুন দাবি নয়, কোনো একক ব্যক্তি বা ‘ক্রিমিনালের' জন্যও নয়৷ অর্থাৎ আন্দোলনরত মানুষ নতুন করে মৃত্যুদণ্ড চাইছে না৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যে বর্বরতম গণহত্যা চালানো হয়েছিল, তার শাস্তি হওয়াটা ছিল খুব জরুরি৷ সেই লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দ্য বাংলাদেশ কোলাবরেটর্স (স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২' বা দালাল আইন আদেশ শিরোনামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়৷ দ্রুত বিচারের জন্য সরকার সারা দেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে৷ ১৯৭৩-এর অক্টোবর পর্যন্ত দুই হাজার ৮৮৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়৷ এ সব মামলায় সাজা দেওয়া হয় ৭৫২ জনকে এবং বাকিদের বিচার কাজ চলছিল৷ প্রাথমিকভাবে এই আইনের আওতায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে সক্রিয় বিরোধিতা করায় মোট ৩৭ হাজার ৪৭১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়৷

Blogger Arif Jebtic
ব্লগার আরিফ জেবতিকছবি: Arif Jebtic

এই আইনটি কোনো কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য করা হয়নি৷ এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনৈতিকভাবে অথবা অন্য যে কোনো পরিস্থিতির চাপে যাঁরা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের বিষয়টিও খুব মানবিকভাবে, ক্ষমা এবং ঔদার্যের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে৷ গুরুত্ব বিবেচনায় অপরাধের মাত্রা কম- এমন অপরাধীদেরকে এ সময় ক্ষমা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়৷

১৯৭৩-এর ৩০শে নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়৷ এতে করে ২৫ হাজার ৭১৯ জন আসামি ছাড়া পান৷ এই ক্ষমা ঘোষণার সময় বলা হয়, সুনির্দিষ্টভাবে ‘ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘর-বাড়ি অথবা জলযানে অগ্নিসংযোগের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হবে না৷' অর্থাৎ এ সময় যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ – এ রকম গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের জন্য চিহ্নিত অপরাধীদের বিচার অব্যাহত রেখে বাকিদের বাংলাদেশের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য ক্ষমা এবং ঔদার্য প্রকাশ করে একটি যুদ্ধবিধ্বস্থ রাষ্ট্র৷

বাকি আসামীদের বিচার চলতে থাকে এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে তদন্তও চলতে থাকে৷ এই অপরাধীদের মাঝে ৭৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজাও হয়৷ পরে ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল হলে ৩১শে ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান ‘দালাল আইন' বাতিল করেন৷ ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়৷ সে সময় চারটি সুনির্দিষ্ট অপরাধে কারাগারে আটক ১১ হাজার আসামি, এমনকি সাজাপ্রাপ্তরাও জেল থেকে ছাড়া পান৷

আবারো বলি, এই টাইমলাইনটির বিষয়টি আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে৷ আজকে যে বিচার বাংলাদেশে অব্যাহত আছে, সেটা কোনো নতুন বিচার নয়, এটা আসলে পুরোনো একটি বিচার, যা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল, সেই বিচারটিই পুনরুদ্ধার করে অব্যাহত রাখা হয়েছে৷

সেই সময়কার বিচারের সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড৷ অপরাধ বিবেচনায় আজকে শীর্ষ যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, তাঁদের সবার অপরাধই মানবতার বিরুদ্ধে জঘণ্যতম অপরাধ, সেখানে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনতা শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করবে, এটাই স্বাভাবিক৷

আজকের যুগে বিশ্বে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড রোধের ব্যাপারে অনেক ‘অ্যাক্টিভিস্ট' কাজ করছেন৷ ইতিমধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ডের মতো চূড়ান্ত শাস্তির বিধান রহিত হয়ে গেছে৷ শান্তির দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বন্ধ করে দেয়াটা হয়ত সমাধান৷ কিন্তু এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শান্তি অর্জন করতে হলে শান্তি স্থাপনের সবগুলো বাধাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই৷

এ প্রসঙ্গে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলের কথাটি এখানে টানা যেতে পারে৷ ইতিহাসের মহত্তম ট্রায়েল হিসেবে যে বিচারকে অভিহিত করা হয়েছে সেই ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলেও ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, কারণ, মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘণ্যতম অপরাধ তারা করেছিল, তাদের মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ভুক্তভোগী মানুষদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে সুস্থ জীবনধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল না৷ যদি কোনো কারণে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েলের বিচার-কাজ স্থগিত কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতো, আমার বিশ্বাস পরবর্তীতে বিচারেও একই রায় দেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না৷

আমাদের বাংলাদেশে এই অবস্থা আরো সমস্যাসংকুল৷ ১৯৭৫ সালে একবার আইন বাতিল করে বিচার শুধু বন্ধই করে দেয়া হয়নি, বরং যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল৷ এই সুযোগে পরবর্তীতে তারা দেশের মধ্যে অর্থ ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি তৈরি করেছে৷ আবার যদি কখনো দূর্ভাগ্যক্রমে এই দেশে তাদের স্বপক্ষের শক্তির কাছে ক্ষমতা চলে যায় তাহলে আবারও এই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে৷ তখন আজকে যে বিচার চালানো হচ্ছে তার শাস্তি হিসেবে কারাভোগী আসামীরা বের হয়ে আসতে পারে৷ সেক্ষেত্রে একটি দেশের ইতিহাসের জঘণ্যতম গণহত্যার আসামীরাই শুধু বেরিয়ে আসবে- শুধু তাই নয়, এই বিচারের বিচারক, আইনজীবী, তদন্ত কর্মকর্তা এবং সাক্ষীরাও জীবনের ঝুঁকিতে পড়বেন৷

বাংলাদেশের মানুষ এই পটপরিবর্তনকে ভয় পায়৷ তাই তারা মনে করে, বিচারের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হওয়াটাই এই আশংকা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়৷ এ জন্যই বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতাদের মৃত্যুদণ্ড না হলে মানুষের মন খারাপ হয়, তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন এবং প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন৷

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে ৪৩ বছর কেটে গেছে৷ বাংলাদেশের মানুষ এখন এই আটকে থাকা বিচারটি সম্পন্ন করে সামনের দিকে তাকাতে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন৷ তাঁরা মনে করেন, ৩০ লক্ষ শহিদের হত্যার বিচার সম্পন্ন করার মাধ্যমে যে মানসিক শান্তি তাঁরা লাভ করবেন, তার মাধ্যমে তাঁরা দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিয়ে কাজ করতে পারবেন৷ ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের উত্তরাধিকারীরা দেশে ও বিদেশে শান্তি স্থাপনে, যুদ্ধ-গণহত্যার বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান ব্যক্ত করে বিশ্বকে আরো সুন্দর করে তুলতে পারেন৷ আর সেটা করতে হলে বিগত যুদ্ধাপরাধের বিচারটি চূড়ান্ত হওয়া দরকার৷ যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত শীর্ষ অপরাধীরা কখনো মুক্তি পাবেন, এমন আশংকা তাঁদেরকে উদ্বিগ্ন করে তোলে৷

বাংলাদেশে চলমান এই বিচারটি কোনোভাবেই কোনো ক্ষোভ ও বিদ্বেষের বিচার নয়, কারণ, সর্বোচ্চ সহনশীলতা ও উদারতা দেখিয়ে যুদ্ধ পরবর্তী সময়েই ২৬ হাজার অভিযুক্তকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে৷ এখন যাঁদের বিচার চলছে, তাঁরা ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন৷ শান্তির জন্য, নিহত লাখো মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারের জন্যই এই বিচার সম্পন্ন করা জরুরি এবং এদের প্রত্যেকটি অপরাধের জন্যই যেহেতু সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য, তাই তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি করা এই দেশের জনসাধারণের অধিকার৷

ন্যুরেমবার্গের ট্রায়ালে ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরেই যুদ্ধবিদ্ধস্থ ইউরোপ আবার শান্তি ও কল্যাণের পথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগোতে পেরেছে৷ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরে বাংলাদেশও শান্তি ও কল্যাণের পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পাবে৷ আর তাই, শান্তি ও কল্যাণের জন্যই গত ৪৩ বছর ধরে আমরা এই অপরাধীদের ফাঁসি চাচ্ছি৷ এদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সেই চাওয়া শেষও হবে না৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য