কেন এই সংঘাত
১৭ জুন ২০২০বেশ কয়েক বছর ধরেই ভারত অভিযোগ করছে, লাদাখেপ্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পার হয়ে ভারতীয় এলাকায় ঢুকে পড়ছে চীন। কখনও পাথরের ওপর চীনা ভাষায় লিখে যাচ্ছে। কখনও ভারতের এলাকায় চীনের সেনা বেশ কিছুদিন থেকে যাচ্ছে। তারপর প্রতিবাদ, আলোচনার পর তারা আবার ফিরে যায়। ভারত, চীন ও ভূটান সীমান্তে ডোকলামে রাস্তা বানানো নিয়ে ৭৩ দিন ধরে সংঘাত ও উত্তেজনা ছিল। কিন্তু এই বার লাদাখে যা হয়েছে, তার কারণটা ভিন্ন বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
এ বারের সংঘাতের কারণ হিসাবে বেশ কেয়কটি বিষয় উঠে আসছে। তার মধ্যে অন্যতম বলা হচ্ছে, কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত। কিছুদিন আগে জম্মু ও কাশ্মীরকে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ। সেটা নিয়ে সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, আকসাই চীনও ভারতের অভিন্ন অঙ্গ। এটা নতুন কথা নয়। ভারতের বরাবরের অবস্থান। কিন্তু লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, চীনের দাবি, লাদাখের বেশ কিছু এলাকা বিতর্কিত ও তাঁরা সেই এলাকা নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। সেই সঙ্গে আকসাই চীন নিয়ে ভারতের দাবিকেও তারা হালকাভাবে নিচ্ছে না।
প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত রায়চৌধুরি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''চীন আমাদের কাছ থেকে সব চেয়ে বড় সম্পদ যেটা নিয়ে নিয়েছে তা হলো আকসাই চীন। সেখান দিয়েই তিব্বত থেকে পাকিস্তানের মধ্যে রাস্তা যাচ্ছে। এরপর লাদাখ নিয়ে সিদ্ধান্তে চীন উদ্বিগ্ন।''
বিরোধের আরেকটি বড় কারণ, লে থেকে দারবুক, শাইয়োক হয়ে দৌলত বেগ ওল্ডি বায়ুসেনা ঘাঁটি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করছে ভারত। দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬,৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের সর্বোচ্চ এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণ করেছে ভারত। এই রাস্তা কারাকোরাম পাসের কাছে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত গিয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লাগোয়া এই রাস্তাই হলো বিরোধের অন্যতম কারণ। ভারত আবার এই রাস্তাকে আরও বিস্তার করতে চাইছে।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটানান্ট জেনারেল সুব্রত সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''চীনের মনে হয়েছে এই রাস্তা তাঁদের কাছে বিপদের কারণ। আমি এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এই জায়গায় রাস্তা বানানো যে কী অসুবিধেজনক তা আমি জানি। অনেক চেষ্টা করে আমরা সফল হয়েছি। এর ফলে দৌলত বেগ ওল্ডি পর্যন্ত আমরা সহজে সেনা নিয়ে যেতে পারব। এর পূর্ব দিকেই আকসাই চীন এবং ওদের হাইওয়ে। উত্তরদিকে সাকসাম উপত্যকা যেটা পাকিস্তান বেআইনিভাবে চীনকে দিয়ে দিয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সে জন্যই চীন রাস্তাটা নিয়ে এতটা চিন্তিত।''
প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন,'' চীন নানাভাবে ভারতকে বিব্রত করতে চাইছে। বিশেষ করে ভারত যখন লাদাখ সীমান্তে কয়েকটি রাস্তা নির্মাণ করেছে, তাতে চীনের ঘোরতর আপত্তি আছে। একইভাবে নেপালের পাশ দিয়ে রাস্তা তৈরি নিয়েও তারা ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছে। সংঘাতের অনেকগুলি কারণ আছে। তার মধ্যে রাস্তা তৈরি একটি কারণ।''
সিবিএসির প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন আর্টিকেল ৩৭০ নিয়ে। তখন তিনি কাশ্মীর, আকসাই চীন, পাক অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে প্রচুর পড়াশুনো করেছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''যদি ইতিহাস দেখা যায়, তা হলে দেখা যাবে অনেক যুদ্ধই হয়েছে ওয়ার্ম ওয়াটার নিয়ে। শীতপ্রধান দেশে অনেক সমুদ্র শীতে নাব্য থাকে না। চীনেরও একই সমস্যা আছে। সাউথ চায়না সমুদ্র নিয়ে কয়েক বছর ধরে প্রবল বিতর্ক চলছে। পাকিস্তানের দাক্ষিণ্যে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ভিতর দিয়ে চীন গুঞ্জেরা পাস হয়ে, স্কার্ডু হয়ে, ইসলামাবাদ গাদার পোর্ট পর্যন্ত রাস্তা বানায়। সেই বন্দর চীন ব্যবহার করে। ওরা খুব ভালো রাস্তা বানিয়েছে। কিন্তু শীত ও বর্ষায় রাস্তাটা বারবার বন্ধ হয়ে যায়।''
সুমিতবাবুর মতে, ''আমার মনে হয়েছে, ওরা বিকল্প রাস্তা বানাতে চাইছে। সেই রাস্তা তিব্বত থেকে সোজা স্কার্ডু পর্যন্ত যাবে। কিন্তু এই রাস্তাটা গালওয়ান হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে নিয়ে দিয়ে যাবে। তখন এলএসি বদলাতে হবে। সেই প্রয়াসটাই চীন শুরু করেছে। চীনের মধ্যে বরাবর একটা আগ্রাসী মনোভাব আছে। তারই ঝলক দেখা যাচ্ছে লাদাখে।''
অমলবাবুর মতে, চীনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা আছে। তিব্বত দখলের পর থেকে তা বেড়েছে। তার ওপর অ্যামেরিকা এখন ভারতের কাছাকাছি এসেছে, তাই চীন বড় চিন্তিত। চীন এখন ভারতকে নানাভাবে বিব্রত করতে চাইছে। নেপালকে দিয়েও তারা ভারতকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে। চীনের প্রবণতা হলো, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে আসা।
যে প্রশ্নটা এরপর সঙ্গতভাবে ওঠে, তা হলো, এরপর কী হবে? অমলবাবু মনে করেন, ''চীনের মনোভাব বদলাবে না। কিন্তু ভারত যুদ্ধের দিকে যাক, আমি তা চাইব না। আমি চাইব, চীনকে উচিত শিক্ষা দিতে ওদের সঙ্গে সব আমদানি ও রপ্তানি বন্ধ করুক ভারত। তাতে ভারতের থেকে চীনের অনেক বেশি ক্ষতি হবে।''
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটানান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলের ফেসবুক লাইভে বলেছিলেন, ''ভারতের তরফেও কিছু কৌশল আছে। ভারত কিছুতেই চীনের আগ্রাসন মানবে না। আর আলোচনায় বসতে হয় সমানে সমানে। ভারতও সেটাই করবে।'' সুব্রত সাহাও বলছেন, ''চীন যদি এরপরও তাঁদের মনোভাব না বদলায়, তা হলে ভারতের সেনাও প্রস্তুত। কিন্তু চীনের বোঝা উচিত, সংঘাত বাড়লে ওদেরই ক্ষতি হবে বেশি।''
জয়ন্তও মনে করেন, ''একটাই পথ ভারতের সামনে রয়েছে। সেটা হলো, জবাব দেওয়া। তার জন্য গুলি চালাতে হয়, চালাতে হবে। এমনিতে প্রথমে গুলি চলে, তারপর মর্টার এবং কামান। তারপর বিমান হানা। পুরোপুরি যুদ্ধে দুই দেশ যাবে না। কিন্তু অতীতে '৬৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী, '৮৪-৮৫তে রাজীব গান্ধী প্রত্যাঘাতের নীতিই নিয়েছিলেন। চীন আসলে দেখাতে চায়, ভারত আদতে দুর্বল। ভারত যদি জবাব না দেয়, তা হলে চীনের প্রচার আরও জোরদার হবে।''
তবে ভারতের এই অভিযোগ মানতে নারাজ চীন। তাদের দাবি, ভারত লাদাখ এবং অরুণাচল সীমান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা মানছে না। চীনের এলাকায় ঢুকে পড়ছে বার বার। আকসাই চীন নিয়ে ভারতের বক্তব্যেরও একাধিকবার বিরোধিতা করেছে চীনের প্রশাসন। সাম্প্রতিক ঘটনার ক্ষেত্রেও চীনের দাবি, ভারতীয় সেনা প্রোটোকল ভেঙে চীনা ভূখণ্ডে ঢুকে তাদের টেন্ট ভাঙার চেষ্টা করেছে। অর্থাৎ, যাবতীয় উত্তেজনার জন্য চীন আঙুল তুলছে ভারতের দিকে।
দুই দেশই যে অন্যের দিকে আঙুল তুলবে, তা স্বাভাবিক। তবে নজর রাখতে হবে আন্তর্জাতিক মহল বিষয়টিকে কোন দৃষ্টিতে দেখছে। এখনও পর্যন্ত অ্যামেরিকা যা মন্তব্য করেছে, তাতে সামান্য হলেও ভারতের দিকে ঝুঁকে। এখন দেখার বাকি দেশগুলি বিষয়টিকে কোন চোখে দেখে। আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়ার উপরেও দুই দেশের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ খানিকটা নির্ভর করবে বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল।