কেন নারীর পোশাকেই বাংলাদেশের সমাজ আটকে যায় বারবার
১১ আগস্ট ২০২৩ফুটবলারদের একমাত্র 'অপরাধ' ছিল আর দশজন ফুটবল খেলোয়াড়ের মতো তারাও শর্টস (হাফপ্যান্ট) পরে ফুটবল অনুশীলন করতেন৷ কেবল এ কারণেই তাদেরকে মারধর করা হলো৷ শুধু কি পিটিয়েই তাদের হাসপাতালে পাঠিয়েছে? আহত খেলোয়াড় মঙ্গলী বাগচীর ধর্ম তুলেও গালাগালি করেছে, বেঁধে রেখেছে, বাবা-মাকে অপমান করেছে৷
খুলনার বটিয়াঘাটায় চার কিশোরী ফুটবলারের ওপর এই হামলা এদেশে যেমন নতুন কোন ঘটনা নয়, তেমনি পোশাককে ইস্যু করে নারীর প্রতি হামলা ও কটুক্তি করার ঘটনাও নতুন নয়৷ মূল বিষয়টা হচ্ছে ‘নারীর পোশাক'৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি কথা খুব চালাচালি হচ্ছে যে ‘নারী কিসে আটকায়?' এর উত্তর হচ্ছে নারী কিছুতেই আটকায় না, কিন্তু নারীর পোশাকে সমাজ আটকায় যায় বারবার৷ সমাজের চোখ শুধু নারীর পোশাকের দিকে- হোক সে খেলোয়ার, ছাত্রী, গায়িকা বা নায়িকা, অফিসের কর্মী অথবা গৃহিনী৷
তবে বটিয়াঘাটা গ্রামের মানুষ মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে কখনো বাধা দেয়নি, বরং সহযোগিতা করেছে৷ কিছু কিছু মানুষ মেয়েদের খেলার বিষয়টি পছন্দ করেন না৷ তারা সুযোগ পেলেই মেয়েদের কটু কথা শোনাতেন৷ কিন্তু গায়ে হাত তোলা এবারই প্রথম৷
বাংলাদেশে নারীর খেলাধুলার বিরোধিতা করে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়ার নজির বিরল নয়৷ ২০১৮ সালে কুড়িগ্রামে ইসলামী আন্দোলন নামের একটি দলের বিরোধিতার মুখে বন্ধ করে দিতে হয় নারীদের একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট৷ সেসময় তারা বলেছিল ফুটবল খেলায় অংশ নেয়া মেয়েদের পোশাক ‘শালীন নয়'৷ কয়েক বছর আগেও হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলার কারণে জাতীয় দলের এক নারী ফুটবলারকে বাসে হেনস্তা হতে হয়েছিল৷ এরপর একজন নারী ফুটবলারের বাবাকে নিজের এলাকায় মারধর করা হয়, কারণ তার মেয়ে হাফপ্যান্ট পরে মাঠে ফুটবল খেলে৷
অন্যদিকে দেশের নারী ফুটবলের অর্জনের তালিকা দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে৷ বয়সভিত্তিক ফুটবলে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা যে অপ্রতিরোধ্য, তা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে৷ শিরোপা জিতেছে বলে এই মেয়েরা সংবর্ধনা ও আর্থিক পুরস্কার পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে৷ বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই মেয়েরা গত সাত আট বছর ধরে দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন, তাহলে ২০২৩ এ এসে কেন ঘটলো এইরকম নেতিবাচক ঘটনা?
আমরা যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই, তাহলে বুঝতে পারবো শুধু এই একটা ইস্যুতেই নয়, নারীর পোশাক পরাকে কেন্দ্র করে এধরনের ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে৷ নরসিংদী রেল স্টেশনে পোশাকের জন্য তরুণী ও তার বন্ধুদের লাঞ্ছনার সেই ঘটনার অডিওসহ ভিডিওটি যারা দেখেছেন, তারা মনে করে দেখুন, স্টেশনে ছাত্রীটিকে যারা লাঞ্ছিত করেছেন, তারাই গলা ফাটিয়ে বলছেন ‘মাফ চা', ‘মাথা নিচু কর, ক্ষমা চা'৷ মেয়েটির অপরাধ সে তার পছন্দ মতো পোশাক পরেছে৷
‘‘বাংলাদেশে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজ বিস্তার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা” (সূত্র: ডিনেট এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন) শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়েছে দেশীয় অনলাইন ও মিডিয়াতে নারীর প্রতি অবমাননাকর, নারীর অশালীন দেহ প্রদর্শন, যৌন আবেদনময় ও পর্নোগ্রফিক কনটেন্ট বা আধেয় বাড়ছে৷ দেশব্যাপি এই গবেষণাটি স্পষ্টভাবে তুলে এনেছে যে, পোশাক বা আচরণ দেখে মুহুর্তেই কোন মেয়েকে ‘ভাল মেয়ে' বা ‘মন্দ মেয়ে' হিসাবে বিচার করার প্রবণতা বাড়ছে৷ এবং ‘মন্দ মেয়ে' বলে মনে হলে তাদের উপর আক্রমণের মানসিকতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ শুধু তাই নয়, আক্রমণ করাটাকেও আক্রমণকারীরা যৌক্তিক বা জায়েজ বলে মনেকরেন ৷
গবেষণাটি বলছে একটি মেয়ে যখন প্যান্ট-শার্ট, গেঞ্জি-প্যান্ট, সালোয়ার-কুর্তি, স্কাট বা টপস, স্লিভলেস ব্লাউজ ও বড় গলার জামা বা ব্লাউজ পরেন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মেলামেশা করেন, সেই মেয়েদের নানাভাবে হেয় করা হয় ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা হয় বলে মনেকরেন গবেষণায় অংশ নেয়া শতকরা ৮১ জন উত্তরদাতা৷
অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এর পাশাপাশি শতকরা ৬৪ জন মানুষ মনে করেন যেসব মেয়ে আচরণ ও পোশাকে সামাজিকতা মানেনা, স্বাধীনভাবে চলতে চান এবং আচরণে নারী-পুরুষ বিভেদ করেন না, তাদের প্রতি অন্য মানুষ কটুক্তি, সমালোচনা, তির্যক মন্তব্য ও অপমানজনক আচরণ করতেই পারেন৷ এরমানে নারী তার পছন্দমতো পেশাক পরলে বা চলাফেরা করলে, সেই নারীদের প্রতি কটুক্তি করা হলে, তা দোষনীয় হবে না৷ যে কারণে নরসিংদী স্টেশনে একজন নারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটিকে হেনস্তা করা শুরু করলে সবাই আক্রমণকারীর পক্ষ নিয়ে মেয়েটি ও তার সঙ্গীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন৷৷
আসলে নারীর পোশাকের প্রতি অন্য নারীর যে ক্ষোভ এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই৷ এর সাথে সম্পর্ক আছে হীনতা, নীচতা, নিজের পরাধীন জীবন, বন্দীত্ব, যৌন ঈর্ষা ও নিজের স্বামী বা ছেলেকে নিয়ে অনিরাপত্তার বোধ (ইনসিকিউরিটি)৷ নারী যে কারণে অন্য নারীকে পোশাকের জন্য হেয় করেন, সেটা প্রধানত হলো নিজের ভেতরে থাকা নারীবিদ্বেষ (ইন্টার্নালাইজড মিসজিনি)৷ গবেষণাটি বলছে আমাদের দেশে ইন্টার্নালাইজড মিসজিনি বাড়ছে৷ এই বিদ্বেষ থেকেই ব্যাপক সংখ্যক নারী, নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন৷
ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত ও নিরাপদ জীবন নিয়ে সমাজে অনিশ্চয়তা, ভীতি ও উৎকন্ঠা বাড়ছে বলে মনেকরেন গবেষণায় অংশ নেয়া শতকরা ৯০ ভাগ উত্তরদাতা৷ এই সমাজ মনেকরে ‘মন্দ মেয়ে'র মত আচরণ সমাজে অনাকাঙ্খিত৷ কারণ তা অন্য ছেলেমেয়েদের নষ্ট করে ফেলবে৷ নারীর প্রতি এই যুক্তিহীন অবমাননাকর ধারণা পোষণ করেন শতকরা ৭৯ জন উত্তরদাতা৷
এই মিসোজিনি বা নারী বিদ্বেষের কারণেই ফুটবলার কিশোরীদের আক্রমণকারীদের মধ্যে পুরুষের সাথে অনেক নারী ছিলেন৷ ফুটবলার সাদিয়া নাসরিন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি যখন ফুটবল খেলছিলেন তখন তার একটি ছবি তোলেন মাঠের সাথে লাগোয়া একটি বাড়িতে থাকা এক তরুণী৷ সেদিন খেলা শেষে বাসায় ফিরে সাদিয়া জানতে পারেন ঐ তরুণী সাদিয়ার মা এবং আত্মীয়স্বজনকে মাঠে তোলা ছবি পাঠিয়ে তার ‘পোশাক নিয়ে কটুক্তি করেছে'৷ শুধু তাই নয়, ঐ তরুণী ও তার মা সাদিয়ার সাথে দুর্ব্যবহার করেছেন "তার মা আমাকে বলছে যে, তুমি হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলবা আর আমরা সেটা নিয়ে কিছু বলতে পারবো না!'', বলেছেন সাদিয়া নাসরিন৷
এছাড়া প্রচুর সংখ্যক কিশোর, যুবক ও পরিণত পুরুষ নারীর প্রতি অবমাননাকর কনটেন্ট নিয়মিত দেখে থাকেন বলে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৮১ ভাগ উত্তরদাতা মনেকরেন৷ পর্নোগ্রাফি নিয়ে আমাদের পুরোনো অনেক ধারণাকে বদলে দিয়েছে দেশীয় কনটেন্টে তৈরি এইসব পর্নোগ্রাফি ফেইসবুক লাইভ, টিকটক, লাইকি, ইমো লাইভ, বাংলা নিম্নমানের সিনেমা এবং ওয়েবসিরিজ৷
সবচেয়ে বিপদজনক হলো অনলাইনে নারীর প্রতি অবমাননাকর যে ইমেজ দেখানো হচ্ছে, তা সমাজে প্রচলিত ‘মন্দ মেয়ে'র ইমেজকে আরো শক্তিশালী কওর তুলছে৷ বাংলাদেশী পর্নোগ্রাফি ও অনলাইনে নারী বিষয়ক কী কী আধেয় রয়েছে, তা দেখতে গিয়ে দেখা গেছে নারীর প্রতি টিটকারি, অবমাননা, প্রতিশোধ, ভার্চুয়াল সেক্স, সেক্স ট্রেড প্রোমো, অশ্লীলতা এবং নিউজ প্রোমো এখানে স্থান পেয়েছে৷
আর তাই অনলাইনে দেখানো ‘মন্দ মেয়ে'র মতো আচরণ যারা করেন, তাদের সেটা থেকে বিরত রাখার জন্য মেয়েদের হেয় করা, তাদের মন্দ কথা বলা ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা সমাজের জন্য ‘উপকারী' বলে মনেকরেন শতকরা ৪৪ জন উত্তরদাতা৷ কিশোরী ফুটবলারদের উপর ও নরসিংদীতে তরুণীর উপর হামলার ঘটনা এটাই প্রমাণ করে৷ এছাড়াও বিভিন্ন নারী সবসময়ই অভিযোগ করেন যে, নিজের ই”ছা মতো আধুনিক পোশাক পরার জন্য তাদের পথেঘাটে হেনস্তা হতে হয়৷
সমাজে ‘ভাল' ও ‘মন্দ' মেয়ে আছে এটা বিশ্বাস করেন শতকরা ৭৯ জন উত্তরদাতা৷ শতকরা ৫২ জন মানুষ মনে করেন মেয়েদের পাশ্চাত্য ধাঁচের বা নিজেদের পছন্দমত পোশাক পরা, মিডিয়ায় কাজ করা, পুরুষের সাথে রাতের শিফটে কাজ করা বা একসাথে বেড়াতে বা কাজে যাওয়া ঠিক নয়৷ যখন কেউ এই আচরণ করেন, তখন তার প্রতি বিরুপ মন্তব্য করেন ও টিটকারি কাটেন শতকরা ৭১ জন পথচারি, এরমধ্যে শতকরা ৩৩ জন নারী ও ৩৮ জন পুরুষ৷
‘মন্দ মেয়ে' নিয়ে সমাজে প্রচলিত যে স্টেরিওটাইপ ধারণা, এর আলোকে শতকরা ৭৪ জন উত্তরদাতা মনেকরেন মন্দ মেয়েরা, মন্দ ছেলেদের চাইতেও বেশি বিপদজনক৷ এখানে নারীকে হেয় করতে গিয়ে পুরুষের আগ্রাসী আচরণকেও সমর্থন দেয়া হয়েছে৷ তাহলে সমাজে ‘ভাল'মেয়ের লক্ষণ কী? যারা ধর্মীয় নিয়ম মানে অর্থাৎ হিজাব করেন, বোরকা পরেন, ছেলেদের সাথে মেশেন না এবং অনলাইনে একাউন্ট নেই, এরাই ভালো মেয়ে৷ আর একজন স্বাধীন নারী হচ্ছেন মন্দ নারী৷ প্রসঙ্গত বলতে চাই, যারা মনে করছেন হিজাব ও বোরকা ইসলামের ব্র্যান্ড, তারা কি একটু পড়াশোনা করে দেখবেন যে দুনিয়াতে হিজাব কি মুসলিমরা প্রচলন করেছিলেন? হিজাবের প্রচলন কারা করেছিলেন এবং কেন করেছিলেন?
বাংলাদেশে একটা বড় অংশ পুরুষ দেশীয় পর্নোগ্রাফি দেখেন শুধু অশ্লীলতা আস্বাদনের জন্য নয়৷ এর চাইতেও বেশি দেখেন নারীকে নির্যাতন ও অপমান করার, নারীকে নিপীড়নের উপায় খুঁজে বের করার এবং নারীর পিঠে ‘‘মন্দ মেয়ের তকমা” লাগানোর জন্য৷ এমনকী মেয়েরা যে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হন, এজন্যও মেয়েরাই দায়ী, এইকথাও বিশ্বাস করেন শতকরা ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা৷ সমাজের অর্ধেকেরও বেশি নারী ও পুরুষ যখন এধরণের অযৌক্তিক চিন্তা করতে পারেন , তখন সেই সমাজ থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা দূর হবে কেমন করে?
এই সমাজে সেক্সসিজম হচ্ছে নারীকে শায়েস্তা করার একটা হাতিয়ার৷ ভয়ংকর দিকটি হ”েছ বাংলাদেশে পর্নো ম্যুভির কনটেন্ট ঠিক করে দি”েছ যে, এই সমাজে কারা ‘ভাল মেয়ে', আর কারা ‘মন্দ মেয়ে'? এই ‘ভালো' বা ‘মন্দ' মেয়েদের সাথে সমাজ কী আচরণ করবে সেটাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে ডিজিটাল পর্নোগ্রাফির এই জগৎ৷ কারণ শতকরা ৮০ ভাগ উত্তরদাতা মনেকরেন মেয়েদের তথাকথিত ‘ভাল' কাজে উৎসাহিত করা ও বলপূর্বক ‘মন্দ' বিষয়ে বাধা দেয়া এবং তাদের নিরাপদে রাখা পুরুষেরই দায়িত্ব৷
ফিরে আসি নারীর পোশাকের আলোচনায়৷ নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের কারণে হেনস্তা ও মারধরের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত শিলাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল মে, ২০২৩ সালে৷ সেই শিলার জামিন আবেদনের শুনানিতে উচ্চ আদালত যে মন্তব্য করেন তা অনেককেই দুঃখিত ও বিস্মিত করেছে৷ হাইকোর্ট বলেছেন, ‘‘গুলশান-বনানীর মতো এলাকায়ও কোনো মেয়ে এধরনের পোশাক পরে রাস্তায় বের হয় না৷ সেখানে গ্রামের মতো একটি জায়গায় বা পাবলিক প্লেসে এরকম পোশাক পরা স্বাধীনতা হতে পারে না৷ কোন অনুষ্ঠানেও এধরনের পোশাক দৃষ্টিকটু৷” হাইকোর্ট অবশ্য যেকোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে পারেন তবে সেটা রায়ে উল্লেখ্য না থাকলে পালনীয় আদেশ বলে গণ্য হবে না৷
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে হাইকোর্টের এই মন্তব্যের উপর ভিত্তি করে যেকোনো সময়ে, যেকোনো নারী, যে কারো হাতে হেনস্তার শিকার হতে পারেন৷ অনেকেই মনে করতে পারেন যে, ‘দৃষ্টিকটু পোশাক পরা' নারীকে নিপীড়ন করা 'আইনসঙ্গত' হবে৷ এই ভয় থেকেই আদালতের মন্তব্য আলোচনার দাবি রাখে৷
তাৎক্ষণিকভাবেই মহিলা পরিষদ বলেছিল, নারীর পোশাক নিয়ে উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের এই পর্যবেক্ষণ জনপরিসরে নারীর স্বাধীন চলাচল ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে৷ যে স্থানে নারীর ব্যক্তি অধিকার, মানবিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হরার কথা, সেখানে এমন মন্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক৷ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তির নারীর মানবাধিকারের প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি ও বক্তব্য পক্ষান্তরে নারীর ন্যায়বিচার পাওয়াকে অসম্ভব করে তুলবে৷
মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, উচ্চ আদালত বিভিন্ন সময়ে নারীর অধিকার, স্বাধীনতা রক্ষায় ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রায় ও নির্দেশনা প্রদান করে আসছেন৷ তবে একজন বিচারপতির এ বক্তব্য, এসব অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন৷
জামিন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশ্যে উচ্চ আদালত যে প্রশ্ন রেখেছিলেন, অর্থাৎ ‘সভ্য দেশে এমন পোশাক পরে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় কি না?' এই বক্তব্যটি নারীর প্রতি অগ্রহণযোগ্য ও বৈষম্যমূলক বলে মতামত দিয়েছিলেন মানবাধিকার ও নারী নেত্রী অ্যডভোকেট সুলতানা কামাল৷ তিনি বলেছিলেন, আদালতের এমন পর্যবেক্ষণে পোশাকের কারণে নারীর প্রতি যে সহিংসতা হবে, তাকে পরোক্ষভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে এবং একই সঙ্গে তা জেন্ডার সংবেদনশীলতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে৷
নারী অধিকার সংগঠনগুলোর এই আশংকা কিন্তু মিথ্যা নয়৷ কারণ আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ী কিশোরী ফুটবল খেলোয়ারদের উপর এই পোশাক পরার অজুহাতেই হামলা চালানো হয়েছে৷ ২০২২ সালে স্লিভলেস পোশাক পরা তরুণীর ছবি তোলার সময় হেনস্তা করা হয়েছিল ফটোগ্রাফার তরুণ ও ঐ তরুণীকে৷ হেনস্তা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা৷ সেই শিক্ষিকা ও তার সহকর্মীদের মতে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে ছবি তোলাটা ‘পর্নোগ্রাফি'র পর্যায়ে পড়ে৷ তারা এও মনে করছেন ¯স্লিভলেস পোশাক পরা আর 'নুডনেস' একই জিনিস৷
ফেইসবুকে প্রচলিত অত্যন্ত অশ্লীল ও নারীকে নির্যাতন করার তথাকথিত ভিডিও গেমগুলো লাখ লাখ ভিউ পাচ্ছে এদেশে৷ বলা যায় এই ভিডিওগুলো আমাদের সমাজের কিছু মানুষের মানসিকতার উপর ভিত্তি করেই তৈরি হচ্ছে৷ অথবা বলতে পারেন মানুষের মনোজগতকে নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক করে তোলার জন্যই এগুলো তৈরি করা হচ্ছে৷ সেই ভিডিওগুলোতে নারীকে যেভাবে মন্দ বলে দেখানো হয় ও হেনস্তা করা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষিকা ও তার সহযোগীরা ঠিক সেইভাবেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন৷
কিশোরী ফুটবলারদের উপর হামলা, ফেইসবুকে অশ্লীল ও নারীর প্রতি নিপীড়নমূলক ভিডিও গেইম, নরসিংদী রেলস্টেশনে ছাত্রীকে হয়রানি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে শিক্ষিকা কর্তৃক একজন ছাত্রীকে অপমান করা এবং গবেষণায় উঠে আসা তথ্য 'দেশীয় পর্নোগ্রাফি, অশ্লীলতার চাইতেও বেশি ব্যবহৃত হয় নারীকে অপমান ও নির্যাতন করার জন্য' সব একই সুতায় বাঁধা বলে আমি মনে করি৷ ডিজিটাল পর্নোগ্রাফির জগৎ সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে এক ধরনের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
যেহেতু আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ মনেকরেন 'মন্দ মেয়ে'র মতো আচরণ যারা করেন, তাদের সেটা থেকে বিরত রাখা জন্য তাকে হেয় করা, মারধর করা, মন্দ বলা ও অপমানজনক আচরণ করা সমাজের জন্য উপকারী৷ সেই ধরনের কিছু ভ্রান্তধারণা থেকেই অসংখ্য নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে৷
বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলির দায়িত্ব হচ্ছে সমাজে ইনক্লুশনের সংস্কৃতি চালু করার কথা বলা, নারী যেন পথে-ঘাটে নিরাপদে, যার যার মতো পোশাক পরে চলাফিরা করতে পারেন, সেই দিকে দৃষ্টি দেয়া৷ ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক পরিসরে কে, কী পোশাক পরবেন তা প্রতিটি ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্ত হওয়া উচিৎ৷ প্রতিটি খেলার জন্য আলাদা পোশাক আছে৷ খেলার সময় প্রতিষ্ঠান যে পোশাক দেবে, সেটাই পরতে হবে৷
পত্রিকায় পড়লাম, পর্বতজয়ী ওয়াসফিয়া নাজনীন বলেছেন, ‘‘পর্বতের চূড়ায় ওঠার চেয়ে একজন নারীর পক্ষে ঢাকার রাস্তায় চলাফেরা করা কঠিন৷ একজন নারীকে বাংলাদেশের পাবলিক প্লেসে চলাচল করার সময় কতটা চাপ সহ্য করতে হয় তা জানি৷” ওয়াসফিয়া যখন একটি মোবাইল ফিন্যানসিয়াল সার্ভিস কোম্পানিকে কাজের জন্য একটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি দিয়েছিলেন, তখন তাকে বলা হয়েছিল, ভদ্র পোশাক পরে ছবি দেয়ার জন্য৷ কারণ ‘‘টি-শার্ট” পরা ওয়াসফিয়ার ছবি তাদের কাছে ‘‘যথেষ্ট ভদ্র” বলে মনে হয়নি৷ জানিনা পোশাকের ভিত্তিতে নারীকে 'ভাল মেয়ে' বা ‘মন্দ মেয়ের' তকমা এঁটে দেয়ার এই সংস্কৃতি থেকে কবে মুক্ত হবে বাংলাদেশ৷
এই সমাজ নারীকে চলাফেরা করার, পছন্দ মতো পোশাক পরার, নিজের ইচ্ছামতো জীবন চালনার জন্য কতটা জায়গা করে দেবে, তা ভাবার বিষয়৷ আর তাই নারীকেই এদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে হবে এবং তা এখুনি৷ তাইতো কিশোরী ফুটবলার যখন বলেন, ‘অতীতে ফুটবল খেলা নিয়ে অনেক কটূক্তির শিকার হয়েছি৷ এবার আহত করা হলো৷ হত্যার হুমকিও দেওয়া হলো৷ তবে আমি খেলা ছেড়ে দেব না৷ যতই বাধা আসুক, ফুটবলের সঙ্গে থাকব৷' তারা বলেছেন, সমাজের নেতিবাচক মনোভাবের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো, তখন আমরাও যেন তাদের সঙ্গে হাত মেলাই৷