কেন মাত্র ৩৭৪ জন রোহিঙ্গাকে নিতে চায় মিয়ানমার?
১৫ মার্চ ২০১৮বুধবার দুপুরে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই ৩৭৪ জনের তালিকা পাঠিয়েছে মিয়ানমার৷ ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মো. খোরশেদ আলম সংবাদ মাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করলেও বিস্তারিত আর কিছু জানাননি৷
একমাস আগে সম্পাদিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকা দেয় মিয়ানমারকে৷ তাদের তথ্য ফরমের চাহিদা পুরণ করেই ওই তালিকা পাঠানো হয়৷ কিন্তু মিয়ানমার বলছে, তালিকায় অনেক সমস্যা আছে৷ ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নেই৷ যাচাই-বাছাই শেষে মিয়ানমার ৩৭৪ জনকেই পুনর্বাসনের উপযোগী বলে নিশ্চিত করেছে৷ এবং তাদের রাখাইনের অধিবাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে৷
রিলিফ, রিহেবিলেটেশন অ্যান্ড রিফিউজি কমিশনার আবুল কালাম আজাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মিয়ানমার শুরুতে বলেছিল, ওরা যেভাবে চেয়েছে, সেভাবে হয়নি৷ কিছু অবজারভেশন দিয়েছিল৷ ওদের চাহিদা অনুযায়ী সেসব তথ্য আমরা দিয়েছি৷ তারা ৩৭৪ জনকে ক্লিয়ার করেছে৷ বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে বলে বলছে৷ ওদের ডিটেইল পেলে তখন আমরা বলতে পারবো আসলে তারা কী বলতে চাইছে৷ তখন আমরা দেখবো৷''
বাংলাদেশ থেকে পাঠানো তথ্যে কোনো ঘাটতি ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘‘একটি নির্দিষ্ট ফরম ছিল৷ তাতে যেসব তথ্যের কথা বলা হয়েছে, আমরা তা পাঠিয়েছি৷ এখন ওরা ঠিক কী সমস্যার কথা বলছে, তা পেলে আমরা সেগুলো দেখতে পারবো৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘ফেরত নিলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে কিনা সেটা পরের ব্যাপার৷ আর এটা ওরা দেখবে৷ আমাদের দিক থেকে সে ব্যাপারে কিছু করার নেই৷''
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে বলছে, ‘‘এই ৩৭৪ জন ৯০টি পরিবারের সদস্য৷ যাদের যাচাই-বাছাই করা হয়েছে, তাদের ভেতরে এক বা একাধিক জনকে আরসার সদস্য বলে সন্দেহ করছে তারা৷ তবে তাদেরকেও তারা ফেরত নিতে চায়৷''
চুক্তি অনুযায়ী, এখন তাদের জাতিসংঘের কোনও সংস্থার মাধ্যমে ফেরত পাঠাতে হবে৷ এজন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ইউএনএইচসিআর-এর সঙ্গে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত করে ফেলেছে৷ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ফিজিক্যাল অ্যারেজমেন্ট চুক্তিতে বলা হচ্ছে, তালিকা হস্তান্তরের দুই মাসের মধ্যে সম্ভব হলে তারা সম্পূর্ণ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শেষ করবে৷ যাচাই-বাছাই শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যাবে৷ তবে চুক্তির শর্তানুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফেরত যেতে হবে স্বেচ্ছায়৷
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে এবার এক জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে৷ তাতে ব্যক্তি নয়, পরিবারের পরিচয় নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আর তাতে ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ আট পৃষ্ঠার একটি ফরম পুরণ করতে হয়৷ সিনিয়র সাংবাদিক শেখ শাহরিয়ার জামান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে দুই দফায় বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়েছিল মিয়ানমার৷ তখনো যাচাই-বাছাই হয়েছে৷ তখন ব্যক্তির আইডেন্টিফিকেশন হয়েছে৷ কিন্তু এবার যাচাই-বাছাইয়ে ব্যক্তি নয়, একটি পরিবারের পরিচয় নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷ আট পৃষ্ঠার একটি ফরমে তা করা হচ্ছে৷ ধরুন, একটি পরিবারে স্বামী, স্ত্রী এবং তাদের দুই সন্তান৷ এই ফর্মের প্রথম দুই পৃষ্ঠা৷ বাকি পৃষ্ঠাগুলো পরিবারের বাকি সদস্যদের জন্য একযোগে৷ ফরমে সবার ছবি, তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট, ওই পরিবারে তথ্যসহ পরিবারের পুরো একটি চিত্র দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা ঘনিষ্ঠভাবে প্রক্রিয়াটি খেয়াল করছি৷ ওই ফরমে বাংলাদেশ যে তথ্য পাঠিয়েছে তাতে সমস্যা থাকার কথা নয়৷ তারা আসলে প্রত্যাবসন বিলম্বিত করতে চায় অথবা রোহিঙ্গাদের একবারেই নিতে চায় না৷ তাদের যদি সদিচ্ছাই থাকবে, তাহলে তারা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারে, কোন ফরমে কোন তথ্য নাই৷ তা কিন্তু তারা বলছে না৷''
তিনি জানান, ‘‘নেপিদোতে গতকালও (বুধবার) একটি বৈঠক হয়েছে৷ সেখানে রাখাইনের ডেভেলপমেন্ট নিয়ে তারা এই বেঠকে কথা বলে৷ তারা বিদেশি কূটনীতিক এবং সাংবাদিকদের ব্রিফ করেছেন৷ তারা ঢালাওভাবে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ার জন্য দায়ী করেছে৷ তারা বলছে, বাংলাদেশের সদিচ্ছার অভাবের কারণেই নাকি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যাচ্ছে না৷''
আর মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহিদুল হক বলেন, ‘‘আসলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চায় না৷ তারা রাখাইনের ডেমোগ্রাফি পরিবর্তন করে দেয়ার কাজ করছে৷ তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে৷ সেখানে এখন যে শেড বানানো হচ্ছে, আমার ধারণা, সেটা রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাখার জন্য নয়৷ তারা ওখান আরো অনেক নৃ-গোষ্ঠীকে নিয়ে আসতে চায়৷ ওখানে বৌদ্ধদের নিয়ে আসা হবে৷ আর এজন্য তারা নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপন করছে৷ আমাদের এখান থেকেও কিছু উপজাতি মিয়ানমারে গেছে কয়েক বছর আগে৷ তাদের মথ্যে থামি এবং চাকমা আছে৷ তাদেরও রাখাইনে পুনর্বাসন করা হবে৷ তাদের উদ্দেশ্য হলো রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের কোনো অস্তিত্ব না রাখা৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশকে আরো সতর্ক হতে হবে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ এবং ইউএনএইচসিআরকে যুক্ত করতে হবে৷''
প্রসঙ্গত, গত বছরের আগস্ট থেকে রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হয়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে৷
মিয়ানমারের এই আচরণ সম্পর্কে আপনার মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷