কেন শাহজাহানকে ধরতে পারছে না পুলিশ?
৯ জানুয়ারি ২০২৪৫ জানুয়ারি রেশন দুর্নীতির তদন্তে গিয়ে সন্দেশখালিতে আক্রান্ত, রক্তাক্ত হন ইডি আধিকারিকরা। তারা উত্তর ২৪ পরগনার জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য শাহজাহানের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিলেন।
লঘু ধারায় ক্ষোভ
গত শুক্রবারের ঘটনায় সন্দেশখালি থানায় অভিযোগ দায়ের করে ইডি। খুনের চেষ্টার মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু পুলিশের ভূমিকায় খুশি নয় কেন্দ্রীয় সংস্থা।
ইডি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, "তৃণমূল কংগ্রেস নেতা শেখ শাহাজাহানের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা–সহ একাধিক অভিযোগ থাকলেও, লঘু ধারায় মামলা দায়ের করেছে রাজ্য পুলিশ। খুনের চেষ্টার ধারা দেওয়া হয়নি। বেশিরভাগই ধারাই জামিনযোগ্য।"
পুলিশের নবনিযুক্ত ডিজি রাজীব কুমার বলেছেন, অপরাধী যে-ই হোক, কাউকে ছাড়া হবে না। কিন্তু ইডির উপর হামলাকারী কেউ এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। একই ভাবে ঘটনার পর প্রায় ১০০ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও অধরা মূল অভিযুক্ত শাহজাহান।
বিস্ফোরক প্রবীণ মন্ত্রী
তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ কার্যত শাহজাহানের পাশেই থাকছেন। বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন মমতা সরকারের মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়।
মন্ত্ৰী বলেন, "ক্যাগ রিপোর্টে কেন্দ্রের লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি ধরা পড়েছে। তার কাছে শাহজাহান কিছুই না। একটা জায়গায় প্রতিরোধ হয়েছে, এর পর কেন্দ্রীয় সংস্থার বিরুদ্ধে জনবিস্ফোরণ হবে। ওদের ইডি থাকলে, আমাদের তৃণমূল ছাত্র পরিষদ আছে।"
সিপিএম সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, "মন্ত্রীর বক্তব্য শুনেই বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূল শাহজাহানের পাশে আছে। তাই তাকে ধরা হচ্ছে না। সন্দেশখালির মতো হিংসাকে তৃণমূল সমর্থন করছে। অন্য জায়গায় যাতে একই ঘটনা ঘটে, তার প্ররোচনাও দিচ্ছেন শীর্ষ নেতারা।"
মন্ত্রীর মন্তব্যে ভবিষ্যতে আরো উত্তেজনার ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করছে বিরোধীরা। পশ্চিমবঙ্গে একাধিক দুর্নীতির তদন্ত চালাচ্ছে ইডি। চলতি পরিস্থিতিতে কৌশল কী হবে, তা ঠিক করতে আলোচনা করছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। ইডি ডিরেক্টর রাহুল নবীন সোমবার মাঝরাতে কলকাতা পৌঁছন। আজ এখানকার ইডি কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি।
পাল্টা দুর্নীতির তাস
চড়া আক্রমণের পাশাপাশি দুর্নীতির তীরে পাল্টা ইডিকে বিঁধতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস। মুখপাত্র কুণাল ঘোষের অভিযোগ, সেদিনের অভিযানে অংশ নেয়া ইডির উচ্চপদস্থ আধিকারিক রাজকুমার রামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চলছে।
তৃণমূলের দাবি অনুযায়ী, আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি থাকার অভিযোগে এফআইআর হয়। সিবিআই এর তদন্ত করছে। বেঙ্গালুরুতে নিযুক্ত থাকাকালীন রামের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। পরে তাকে গুয়াহাটি শাখায় বদলি করা হয়। সেখান দুর্নীতির তদন্তে কলকাতায় এসেছেন রাম।
শাহজাহান কোথায়?
তৃণমূলের দাপুটে নেতা কোথায় আছেন, তা নিয়ে বিস্তার জল্পনা চলছে দিন চারেক ধরে। স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রধান হাজি সিদ্দিকি মোল্লা দাবি করেছেন, ঘটনার পর এলাকাতেই তার সঙ্গে শাহজাহানের দেখা হয়েছিল। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, এই প্রধানের বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন ফেরার শাহজাহান।
শাহজাহানের ভাই শেখ আলমগির ইডির উপর হামলার ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত। মঙ্গলবারও তিনি টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে এসে বক্তব্য রেখেছেন। আলমগির বলেন, দাদা কোথায় আছেন সেটা তার জানা নেই। ফোনেও যোগাযোগ করতে পারছেন না।
বিরোধীদের প্রশ্ন, সাংবাদিকরা যার নাগাল পাচ্ছেন, তাকে কেন এখনো গ্রেপ্তাত করতে পারল না পুলিশ? তা হলে কি শাহজাহান সন্দেশখালিতে থাকলেও তাকে ধরা হচ্ছে না?
পুরনো মামলার ফাঁস
শাহজাহানের উপর চাপ আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা। শুধু সন্দেশখালির সাম্প্রতিক ঘটনাই নয়, ফিরে আসছে ২০১৯ সালের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি।
সেই বছর জুনে তিন বিজেপি কর্মীকে খুনের অভিযোগ ওঠে শাহজাহানের বিরুদ্ধে। প্রদীপ, সুকান্ত ও দেবদাস মন্ডলকে হত্যা করে দেহ লোপাটের অভিযোগও উঠেছিল। দলের মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "প্রদীপ মন্ডলের চোখে গুলি করেছিল। দেবদাস মন্ডলের দেহ আজো পাওয়া যায়নি। সেই শাহজাহানকে পুলিশ ধরবে না। পুলিশকে ওই নেতাই চালান। তাই সন্দেশখালিতে নিজের সাম্রাজ্যের মধ্যেই পুলিশের তত্ত্বাবধানে তিনি রয়েছেন।"
এই হত্যা মামলা ফের শুরু করে, সিবিআইকে তদন্তভার দেয়ার আর্জি জানিয়েছে নিহতদের দুই পরিবার। তাদের দাবি, সিআইডির চার্জশিটে শাহজাহানের নাম ছিল। পরে তার নাম বাদ দেয়া হয়। হাইকোর্ট মামলা দায়েরের অনুমতি দিয়েছে। চলতি সপ্তাহে শুনানি শুরু হতে পারে।
প্রবীণ সাংবাদিক দেবাশিস দাশগুপ্ত বলেন, "ভারতেএমন ঘটনা হয়তো আরও পাওয়া যেতে পারে। অতীতে শাহজাহানের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তার টিকি ছুঁতে পারেনি। এবারও একই দৃশ্য। শাসকের প্রশ্রয়ে তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন।"
তৃণমূলের জেলা কোর কমিটি সোমবার শাহজাহানকে মৎস্য কর্মাধ্যক্ষের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এটাকে 'আইওয়াশ' বলেই মনে করছেন দেবাশিস।
সন্দেশখালি বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। সেখানে গতবার সহজেই জিতেছিল তৃণমূল। তাতে সুন্দরবন লাগোয়া প্রত্যন্ত সন্দেশখালির বড় ভূমিকা ছিল। লোকসভা নির্বাচনের আগে সারা রাজ্যের নিরিখে চলতি ঘটনাবলীর কী তাৎপর্য রয়েছে?
রবিবার সিপিএমের যুব সংগঠনের ব্রিগেড উদ্দীপনা দেখেও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলেন, "শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশে ভোট দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। একদল বিজেপির পক্ষে। বিজেপি বিরোধীরা কোনো একটি শক্তিশালী প্রার্থীকে বেছে নিচ্ছেন। এই রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপির লড়াই দেখা যাবে। সাগরদিঘি ছাড়া সাম্প্রতিক সব উপনির্বাচন এটাই দেখিয়ে দিয়েছে।"