কেন্দ্র-রাজ্যের দ্বৈরথে নাজেহাল সিবিআই!
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯সিবিআই বনাম কলকাতা পুলিশের লড়াইয়ের মূলে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ৷ মমতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তে বাধা সৃষ্টি করে তাতে রাজনৈতিক রং লাগানোর অভিযোগে সরব কেন্দ্রীয় সরকার এবং শাসক দল বিজেপি৷ মমতা অবশ্য পাশে পেয়েছেন অতীতে সিবিআইয়ের ‘খোঁচা খাওয়া' একাধিক নেতা-নেত্রীকে৷
মমতা যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলেছেন তার জবাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং বলেছেন, ‘‘সারদা কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে ইউপিএ আমলে৷ সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত৷ ফলে এতে এনডিএ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই৷''
অন্যদিকে সিবিআইয়ের দাবি, কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে গ্রেপ্তার করা হলে অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ পাবে৷প্রসঙ্গত, চিটফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্তকারী দলের প্রধান ছিলেন রাজীব কুমার৷ সেই তদন্তকারী দল গঠন করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য সরকার৷ অভিযুক্তদের প্রায় সবাই রাজ্য সরকারের ঘনিষ্ঠ৷ কেউ নেতা, কেউ মন্ত্রী৷ আইপিএস অফিসার রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ– তদন্তের দায়িত্ব পেলেও তিনি আসলে অভিযোগের প্রমাণ লোপাট করেছেন৷ সারদাকাণ্ডে মামলাকারী কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান ও বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যরা শুরু থেকেই এই অভিযোগ করে আসছেন৷ সিবিআইয়ের তদন্তে রাজীব কুমারের অসহযোগিতার অভিযোগ আগেও জমা পড়েছে সুপ্রিম কোর্টে৷ সেবার সুপ্রিম কোর্ট উভয় পক্ষকে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে বলেছিল৷ তখন রাজীব কুমার কলকাতার বিধাননগর পুলিশ কমিশনার ছিলেন৷ বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে তিনি কলকাতার পুলিশ কমিশনার৷ সিবিআই আধিকারিকরা বলছেন, গত কয়েক মাসে অনেকবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলেও রাজীব কুমার তাতে কোনো সাড়া দেননি৷ সিবিআই-এর বক্তব্য হলো, ‘‘গত কয়েক মাসে পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হলেও তিনি আসেননি৷ তাই বাধ্য হয়েই তাঁর বাড়িতে যেতে হয়েছিল৷'' সিবিআই আরো বলেছে, শুধু রাজীব কুমার নন, তালিকায় নাম আছে আরো অনেক পুলিশ কর্মকর্তার৷
ওদিকে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠির কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং৷ রাজ্যপালের রিপোর্ট হাতে এলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে কেন্দ্র৷ এখানেই অনেকে মনে করছেন, বাংলায় আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার অজুহাতে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হতে পারে৷ তবে কেন্দ্রীয় সরকার বা শাসক দল বিজেপি'র তরফে তেমন কোনো ইঙ্গিত মেলেনি৷
রাজনাথ সংসদে বলেছেন, ‘‘কলকাতায় যা ঘটেছে তা অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, দুর্ভাগ্যজনক৷ রাজ্যে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে চলেছে৷ সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে চিটফান্ড মামলার তদন্ত করছে সিবিআই৷ এই মামলায় বহু প্রভাবশালী রাজনীতিকের নাম জড়িয়েছে৷ রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ আছে৷ এতকিছুর পর কোনো রাজ্য সরকার বা তাদের পুলিশ সিবিআইয়ের মতো কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে না৷ সিবিআই আধিকারিকদের আটক করে, হেনস্থা করে থানায় আটকে রাখার ঘটনা স্বাধীন ভারতে নজিরবিহীন৷''
যদিও রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস অন্য কথা বলছে৷
তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কাকলি ঘোষদস্তিদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত পাঁচ বছর ধরে নানাভাবে ভারতীয় সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে বিজেপি সরকার৷ শুধু বাংলা নয়, সব রাজ্যেই কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে বিরোধীদের জব্দ করার অপচেষ্টা চলছে৷ মনে রাখতে হবে, রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টিতে স্থগিতাদেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট৷ আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে না সিবিআই৷ তা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের অঙ্গুলি হেলনে সিবিআইয়ের ৪০জন অফিসার রাতের অন্ধকারে শহরের পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে চড়াও হয়েছেন৷ ওঁরা আদালতের নির্দেশ অবমাননা করেছেন৷''
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তে রাজ্যের প্রধান হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাস্তায় নেমে অভিযুক্তের গ্রেপ্তারিআটকানো ও তদন্তে বাধা দেওয়ার ঘটনা মোটেই ভালো চোখে দেখছে না বহু মানুষ৷ প্রশ্ন উঠছে, মুখ্যমন্ত্রী যদি নিজেই অভিযুক্তকে আড়াল করেন, তাহলে তদন্ত হবে কীভাবে? আইন, বিচার সবই তো প্রহসন হবে৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুগত হাজরা ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে৷ একজন মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে গিয়েছেন, যাঁকে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়৷ তাঁর গ্রেপ্তারি আটকাতে মুখ্যমন্ত্রী, যিনি প্রশাসনিক প্রধান, তিনি রাস্তায় নামলেন৷ এটা কখনোই কাম্য নয়৷ পশ্চিমবঙ্গে চিটফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্ত করছে সিবিআই৷ এই কেলেঙ্কারিতে কোটি কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়েছে৷ যা ঘটেছে তা অনুচিত৷ পুরো ঘটনাটি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য কলঙ্ক হয়ে রইল৷''
অনেকেই বলছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তে সবরকম সহযোগিতা করা উচিত৷ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরি মনে করেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের এই দ্বন্দ্ব সমীচীন নয়৷ সিবিআই, ইডি, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠানগুলিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হলে সেই সংস্থাগুলির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ায়, যা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক৷'' সমাধান কী? তাঁর মতে, ‘‘এই সমস্যায় সম্ভবত রাজনৈতিক সমাধান বা বোঝাপড়ার আর জায়গা নেই৷ লোকসভা নির্বাচন আসন্ন৷ তবে সাংবিধানিক সংকট হলে আদালতে মীমাংসা হতে পারে৷ সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি শুনতে চেয়েছে৷ তাই আদালতের দিকেই নজর রাখতে হবে৷''
তবে বিষয় যখন দুর্নীতি তখন সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ ভারতীয় জনতা পার্টি৷ তারা তৃণমূল নেত্রীকে কোণঠাসা করার চেষ্টায় কসুর করছে না৷ দলের নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের অভিযোগ, অভিযুক্তদের আড়াল করছে তৃণমূল৷ সারদা মামলায় কারা জড়িত, তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ মামলাকারীরা ছিলেন বামপন্থি ও কংগ্রেসের নেতা৷ বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগেই এই দুর্নীতি সামনে এসেছিল৷ ২০১৪ সালের ৮ মে রাহুল গান্ধীর এক টুইটের উল্লেখ করেছেন তিনি৷ টুইটে রাহুল চিটফান্ডকাণ্ডে ২০ লক্ষ আমানতকারীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলেছিলেন৷ এখনো কংগ্রেস ও বাম দলের রাজ্য নেতারা সিবিআই তদন্ত চাইছেন৷ তাহলে বিজেপির ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে কেন? বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিং অভিযোগ করেছেন, ‘‘সারদাকাণ্ড অনেক বড় কেলেঙ্কারি৷ তৃণমূলের সব নেতা, নেত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে৷ রাজীব কুমার মমতা ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার৷ সিবিআইয়ের অভিযোগ, তিনি তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করেছেন৷ এমন একজন অফিসারকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে৷'' সরব হয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিও৷ তাঁর অভিযোগ, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছে৷ রাজীব কুমারকে গ্রেপ্তার করলেই সত্য প্রকাশ পাবে৷''
যদিও তৃণমূল বিষয়টিতে রাজনীতিই দেখছে৷
তাই তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও'ব্রায়েন বলেন, ‘‘গত ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাবেশে ২২ দলের উপস্থিতি দেখে ভয় পেয়েছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা৷ রাজনৈতিকভাবে লড়াইয়ে পরাজয় নিশ্চিত জেনে সিবিআইকে অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ এর পেছনে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল৷''