কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার: ৬৮ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি কমপ্লেক্স
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কত লাখ অনুকৃতি বাংলাদেশে হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই৷ তবে এর শিল্পী হিসেবে হামিদুর রাহমান আমাদের সঙ্গে চিরদিনের মতো রয়ে যাবেন৷ ‘হৃৎকলমের টানে’ বইয়ে এমন মন্তব্য করেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক৷ বাঙালির অনন্য গৌরবের পীঠস্থান এই শহীদ মিনার নিয়ে তৃপ্ত হতে পারেননি হামিদুর রাহমান৷ বরং তার মধ্যে ছিল আক্ষেপ৷ কারণ, মূল যে পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়িত হয়নি৷ এখনো সেটা খণ্ডিতরূপেই দাঁড়িয়ে আছে৷
সেই ষাটের দশকের শেষদিকে প্রবাসী হয়ে যাওয়া হামিদুর রাহমান সবশেষ ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৮৬ সালে৷ শহীদ মিনারে গিয়ে দুঃখ করেন তিনি, বলেছিলেন, ‘‘মিনারের স্ট্রেইন গ্লাস এখনও লাগানো হয়নি! ওটা আমার পরিকল্পনায় ছিল৷’’ তারই ছোট ভাই নাট্যকার সাঈদ আহমদ এ প্রসঙ্গ টেনেছেন এক স্মৃতিকথায়। তিনি আরো লিখেন, ‘‘হামিদুর রাহমানও তার স্বপ্নের শহীদ মিনারের পূর্ণ বাস্তবায়ন করে যেতে পারলেন না৷’’
শহীদ মিনারের শিল্পী হামিদুর রাহমান ১৯৮৮ সালে মারা যান ক্যানাডায়৷
শহীদ মিনার কমপ্লেক্স : যা ছিল প্রস্তাবে
এ প্রসঙ্গে বাংলাপিডিয়ার বিবরণ এমন- ‘‘নকশায় মিনারের মূল অংশে ছিল মঞ্চের ওপর দাঁড়ানো মা ও তাঁর শহীদ সন্তানের প্রতীক হিসেবে অর্ধবৃত্তাকার স্তম্ভের পরিকল্পনা৷ স্তম্ভের গায়ে হলুদ ও গাঢ় নীল কাচের অসংখ্য চোখের প্রতীক খোদাই করে বসানোর কথা ছিল, যেগুলি থেকে প্রতিফলিত সূর্যের আলো মিনার-চত্বরে বর্ণালির এফেক্ট তৈরি করবে৷ এছাড়া মিনার-স্থাপত্যের সামনে বাংলা বর্ণমালায় গাঁথা একটি পূর্ণাঙ্গ রেলিং তৈরি ও মিনার চত্বরে দুই বিপরীত শক্তির প্রতীক হিসেবে রক্তমাখা পায়ের ও কালো রঙের পায়ের ছাপ আঁকাও মূল পরিকল্পনায় ছিল৷ পাশে তৈরি হওয়ার কথা ছিল জাদুঘর, পাঠাগার ও সংগ্রাম-বিষয়ক দীর্ঘ দেয়ালচিত্র (ম্যুরাল)৷’’
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার একটি ছিল শহীদ মিনার নির্মাণ৷ মতিউর রহমান সম্পাদিত ‘একুশের পটভূমি একুশের স্মৃতি’ বইয়ে তা উল্লেখ করেছেন রফিকুল ইসলাম৷ ‘শহীদ মিনারের কথা’ শিরোনামে তিনি আরো লিখেছেন, ১৯৫৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়৷ আর কাজ শুরু হয় ১৯৫৭ সালে৷ প্রাদেশিক সরকারে তখন আওয়ামী লীগ৷ তাদের ক্ষমতার ১৪ মাসে শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দ্রুত অগ্রসর হয়৷
স্থাপত্য অধিদপ্তরে সংরক্ষিত নথি ও ১৯৫৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রণীত শহীদ মিনারের মূল নকশার তথ্যমতে, ১৯৫৬ সালে শহীদ মিনার নির্মাণকাজের তত্ত্বাবধানে ছিল সিঅ্যান্ডবি (তৎকালীন সড়ক ও গণপূর্ত বিভাগ)৷ নকশা প্রণয়নে হামিদুর রহমানের সহযোগী ছিলেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ৷ আর সরকারের পক্ষে ছিলেন তৎকালীন প্রধান সরকারি স্থপতি জিন ডেল্যুরেন৷ তখন নির্মাণকাজ এগিয়ে চললেও ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে তা থেমে যায়৷ এরপর পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে তিনদফা শহীদ মিনার নির্মিত হয়৷ কিন্তু কোনোবারই পরিকল্পনার পুরোটা আলোর মুখে দেখেনি৷
তবে এর পেছনে প্রশাসনের অনীহা শুধু নয়, স্থাপত্য-বাস্তবতাও থাকতে পারে৷ কারণ, বাস্তবায়নযোগ্য কারিগরি নকশায় অনেক সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে করা হয় বলে মনে করেন স্থাপত্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান স্থপতি আ. স. ম. আমিনুর রহমান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শহীদ মিনারের আদি নকশা আমি দেখেছি, সেখানে মিউজিয়ামের বিষয়টি ছিল না৷ তাদের পরিকল্পনায় থাকতে পারে, কিন্তু নকশায় সমন্বয় করা হয়নি৷ তবে নকশায় আট ফুটের বেদি ছিল৷’’
তবে তিনি বলছেন, ‘‘মা ও সন্তান মিলিয়ে শহীদ মিনারের যে থিম, তা চমৎকার কাজ, শৈল্পিক তো বটেই৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনা নিয়েও অনিশ্চয়তা
চার বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে মহাপরিকল্পনা সামনে আসে সেখানেও রয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার৷ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ১৬টি ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে একে অন্যতম হিসেবে যুক্ত করেন সংশ্লিষ্টরা৷
বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনায় শহীদ মিনার চত্বর বড় করার দিকে জোর দেওয়া হয়, যাতে শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা এলাকা যানজটের মতো বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত থাকে৷ আর বজায় থাকে এর গাম্ভীর্য৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নতুন মহাপরিকল্পনা তৈরির কমিটিতে যুক্ত ছিলেন স্থাপত্য অধিদপ্তরের তখনকার প্রধান স্থপতি আ. স. ম. আমিনুর রহমান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, শহীদ মিনার এলাকায় একটি ভাষা জাদুঘর করার কথা৷ সেখানে দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীরা ভাষা আন্দোলন ও এর শহিদদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন৷
তিনি আরো বলছেন, ‘কেন্দ্রীয় শহীদ ম‘‘নার এলাকার পরিসর বড় করা সময়ের চাহিদা৷ মহাপরিকল্পনার কমিটির সবাই এ বিষয়ে একমত ছিলেন৷ এর জন্য সামনে রাস্তা বন্ধ করা, আশপাশের আবাসনগুলো সরিয়ে ফেলার বিষয়েও সব পক্ষের সম্মতি ছিল৷ কিন্তু শহীদ মিনারের পেছনে সোজা একটি রাস্তা করার প্রস্তাব রাখা হলেও সে স্থানটি ঢাকা মেডিকেলের জায়গায় থাকার কারণে তা ঝুলে যায়৷’’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সঙ্গে সমন্বয় না হওয়ায় যে শহীদ মিনার নিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না- সম্প্রতি গণমাধ্যমে এমন ভাষ্য দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল৷ যোগাযোগ করা হলে ডয়চে ভেলের কাছে তিনি এ বিষয়টিই তুলে ধরেন৷
উচ্চ আদালতের নির্দেশনা: বাস্তবায়ন কবে?
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ফটকের একপাশে সাইনবোর্ডে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা তুলে ধরা হয়েছে৷ যেখানে রয়েছে এর মর্যাদা, ভাবগাম্ভীর্য ও পবিত্রতা সংরক্ষণের তাগিদ৷ নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, ভাষাসৈনিকদের প্রকৃত তালিকা তৈরি, শহীদ মিনারের পাশে একটি লাইব্রেরিসহ ভাষা জাদুঘর নির্মাণের মতো বিষয়৷ ২০১০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রোববার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ ধরনের আদেশ দেন৷ এর পেছনে ছিল মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ-এর একটি রিট৷ সেখানে আবেদনকারী আইনজীবী হিসেবে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ৷ রিট করার প্রেক্ষাপট জানতে চাইলে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার একটি পবিত্র জায়গা, যেখানে ভাষাশহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে আমরা সমবেত হই৷পত্রিকায় প্রতিবেদন এসেছিল, সেখানে মাদকাসক্ত ঘুরে বেড়ায়, রাতে অসামাজিক কাজ হয়, কুকুর ঘুরতো৷ এটা পড়ে আমরা রিট পিটিশন করি৷’’
তিনি আরো বলেন, শিল্পী হামিদুর রাহমানের নকশায় শহীদ মিনার নিয়ে আরো ব্যপক পরিকল্পনা ছিলো৷ এটা আদালতে আলোচনায় এসেছিল৷ রিটের শুনানি হওয়ার পর হাইকোর্ট শহীদ মিনার নিয়ে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছিল৷ এরমধ্যে ছিল- কেউ যেন মূল বেদিতে জুতো পায়ে না ওঠে৷ নিরাপত্তার জন্য সিটি কর্পোরেশন ও পুলিশকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল৷ উচ্চ আদালতের নির্দেশনার কারণে নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতার মতো বিষয়ে অগ্রগতি হলেও অন্য সব বিষয়ে অগ্রগতি কম৷ এ বিষয়ে আবার আদালতে যাবেন বলেও জানিয়েছেন মনজিল মোরসেদ৷