1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কোটা আন্দোলন কি নতুন রাজনীতির জন্ম দিচ্ছে?

৩১ জুলাই ২০২৪

কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার দিয়েও দমন করা যাচ্ছে না বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন। আন্দোলনের তীব্রতা কমে এলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ চলছে।

https://p.dw.com/p/4iwQh
ঢাকায় নারীদের সমাবেশ
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে সমর্থন জানিয়ে সমাবেশছবি: Marzia Hassan Prova

 বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই আন্দোলন বাংলাদেশে এক নতুন রাজনীতির জন্মের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আন্দোলনে সহিংসতা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা এখনও নিশ্চিত হওয়ায় যায়নি। সরকার এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১৫০ বলে জানিয়েছে৷ তবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম এ সংখ্যা অন্তত ২১০ বলে জানিয়েছে। এদের বেশিরভাগই তরুণ, কেউ কেউ শিশু। আহত হয়েছেন আরো কয়েক হাজার।

আন্দোলন ছড়িয়ে যাওয়ার পর দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়, পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী এবং বিজিবি। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে।

কিছু বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে কারফিউ শিথিল করা হলেও এখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে।

সরকারের প্রতি অনাস্থা বাড়ছে?

আন্দোলন এভাবে গড়ে উঠবে এবং দ্রুত ছড়িয়ে যাবে, এমনটা আন্দাজ করতে পারেননি বিএনপির অনেক নেতাও। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই আন্দোলন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনগণের অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ।

তিনি বলেন, "আমি মনে করি, সরকারকে এখন অনেক হিসাব-নিকাশ করে কাজ করতে হবে। পাঁচ বছরের জন্য যে-কোনো কিছু করার লাইসেন্স পাওয়া গেছে, এমন মানসিকতা থেকে তাদের বের হয়ে আসতে হবে।"

২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে আরো তিনটা নির্বাচনেও জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে এই তিনটি নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ।

আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনে পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেউ কেউ আগের সব আন্দোলনের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখতে চাইছেন।

এবারের আন্দোলন দমনের জন্য কেবল রাজধানী ঢাকাতেই দুই শতাধিক মামলায় দুই লাখের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে। দেশজুড়ে কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১২ দিনে অন্তত ২৫৩ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছেডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার দৈনিক প্রথম আলো।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দলের অন্য নেতাদের মতে, কোটা আন্দোলনকে 'ছিনতাই' করেছে বিএনপি-জামায়াত। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে সরকার।  ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করা দলটির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন মামলার রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ থাকলেও এখনও দল হিসাবে জামায়াতের বিচারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম দাবি করেছেন, আন্দোলনে ‘অশুভ শক্তি' এবং "মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি" জড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, "ঘটনা যেভাবে ঘটেছে তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।"

নাছিম অবশ্য আওয়ামী লীগের নানা ঘাটতির কথাও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, "আমাদের দলের নেতৃত্বে কিছু গ্যাপ ছিল, সমন্বয়ের অভাব ছিল, সেটা তো অস্বীকার করার কিছু নেই। সামনে আমাদের এ নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে।" দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা হবে বলেও জানান তিনি।

‘সরকার সব সীমা অতিক্রম করেছে'

সরকারের পক্ষ থেকে সব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হলেও সেটা সহজ হবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে গোয়েন্দা পুলিশের বিরুদ্ধে। তাদের কাউক বাসা থেকে, কাউকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। রোববার (২৮ জুলাই) ডিবি অফিস থেকে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ানোর অভিযোগও উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

কিন্তু সে রাতেই আরো কয়েকজন সমন্বয়ক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়াই আন্দোলন গড়ে তোলা ও চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশে 'অভূতপূর্ব' বলে মনে করেন রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব গড়ে উঠছে বলেও মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, "টানা ১৬ বছর ধরে একই দল ক্ষমতায় থাকায় ধীরে ধীরে একটি ব্যাক্তিকেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যে-কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য সবাই এখন প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে।"

এই আন্দোলন এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে বলে মনে করেন ড. সিদ্দিকী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একে অপরের রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করার বদলে একে অপরকে ধ্বংসের রাজনীতি করে এসেছে। তিনি বলেন, "তরুণ প্রজন্ম এই ধরনের রাজনীতি আর পছন্দ করছে না। এটা যদি এই দুই দল বোঝার চেষ্টা না করে, তাহলে তাদের আর নেতৃত্ব না-ও থাকতে পারে।"

এমনকি এই আন্দোলনের মাধ্যমে এই দুই দলের বাইরে তৃতীয় কোনো শক্তিশালী দলের আবির্ভাব হতে পারে বলেও ধারণা তার।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ মনে করেন, সরকারের ওপর এই আন্দোলনের প্রভাব এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যে বাতাবরণ সরকার তৈরি করার চেষ্টা করে আসছিল, এই আন্দোলন সেটার অবসান ঘটিয়েছে। অতীতেও এই সরকারের কোনো নৈতিক অবস্থান ছিল না, ফলে এখন বলপ্রয়োগ ছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।"

এবারের ‘‘দমনপীড়নের মাধ্যমে': সরকার "সব ধরনের সীমা অতিক্রম করেছে" বলে মন্তব্য করেছেন আলী রীয়াজ। তিনি মনে করেন, "মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে যা বুঝতে পারছি, এই আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের সব বৈধতার অবসান ঘটেছে।"

বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমনে সরকার আপাতত সফল বলে মনে হলেও এই আন্দোলন চলতে থাকবে বলেও মনে করেন তিনি।